পরিবার কি, পরিবার কাকে বলে, পরিবার কী ধরনের শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান, বৈদিক সমাজে পরিবারের প্রধান কে ছিলেন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

প্রশ্নপত্র

পরিবার কি

সাধারণভাবে পরিবার বলতে বোঝায় কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টিকে যারা একত্রে বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও আন্তরিক সম্পর্ক বিরাজ করে।

বিবাহ, রক্ত সম্পর্ক ও আত্মীয়তা সূত্রের বন্ধনে আবদ্ধ একটি সামাজিক গোষ্ঠী (Social Group) হলো পরিবার। পরিবার হলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, আন্তরিক ও মুখোমুখি সম্পর্কযুক্ত (Face to face relationship) একটি মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে পরিবারের বাইরের কোনো ব্যক্তির স্থান নেই।

অবশ্য দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে পরিবার বহির্ভূত ব্যক্তিকে পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তখন সেই ব্যক্তি আর অন্য পরিবারের সদস্য থাকে না, হয়ে যায় সেই পরিবারভুক্ত।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিনিয়ত পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া (Interaction) চলতে থাকে। প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব আদর্শ, ঐতিহ্য, প্রথা থাকে যা সেই পরিবারের সদস্যরা বজায় রাখে, সযত্নে লালন করে ও সে অনুযায়ী তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

পরিবারের ধারণা বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নারী-পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে সন্তান প্রজনন ও বংশ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে পরিবার গঠিত হয়; তাই পরিবারকে একটি জৈব একক (Biological Unit) বলেও অভিহিত করা যায়।

পরিবার কাকে বলে

পরিবার Family) হলো মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের এক বিশ্বজনীন (Universal) রূপ। পৃথিবীতে মানুষের সমাজ যতদিনের পরিবারের অস্তিত্বও ঠিক ততদিনের। পরিবারের একক কোনো সংজ্ঞা পাওয়া কঠিন। পরিবারের সংজ্ঞা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

পরিবারের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Family’ কথাটি এসেছে রোমান শব্দ ‘Famuleas’ শব্দ থেকে যার অর্থ ‘ভৃত্য বা সেবক’। রোমের আইন ব্যবস্থায় ক্রীতদাস ও উৎপাদক গোষ্ঠী, অন্য ভৃত্যগণ, অভিন্ন বংশ বা বিবাহসূত্রে সম্পর্কিত অন্য সদস্যদের বোঝানোর জন্য ‘Famulus’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো।

আবার অনেকে মনে করেন, ‘Family’ ’শব্দটি ল্যাটিন ‘Familia’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘সেবক’। শব্দের উৎপত্তি নিয়ে যেমন মতভেদ রয়েছে তেমনি সংজ্ঞা নিয়েও মতভেদ থাকাটাই স্বাভাবিক।

সমাজে অবস্থিত বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গোষ্ঠী হল পরিবার। পরিবার হল প্রাথমিক গোষ্ঠী এবং সমাজ গঠনের মূল একক। সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি স্তরে পরিবারের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তির জন্ম , বেড়ে ওঠা , ব্যক্তিত্ব গঠন ও সামাজিকীকরণ – ইত্যাদি সবকিছুরই বিকাশ ঘটে পরিবারের মধ্যে। অর্থাৎ , সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে পরিবার হল একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। 

এখানে বিভিন্ন মতের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানীর মতামত তুলে ধরা হলো:

  • অগবার্ন ও নিমকফ বলেছেন – পরিবার হল মোটামুটিভাবে স্থায়ী এবং স্বামী – স্ত্রী – র জৈবিক ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি প্রাথমিক গোষ্ঠী। 
  • কিংসলে ডেভিস বলেছেন – পরিবার হল পরস্পরের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক ও বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি নির্দিষ্ট ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। 
  • লক ও বার্জেস বলেছেন – পরিবার হল রক্তের সম্পর্ক , বৈবাহিক সম্পর্ক বা দত্তক সূত্রে আবদ্ধ একটি সুসংবদ্ধ প্রাথমিক গোষ্ঠী। 

সুতরাং পরিবার হল একত্রে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র সামাজিক গোষ্ঠী যা বিবাহসূত্রে , রক্তের সম্পর্ক ও জন্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং এই গোষ্ঠীর মধ্যেই ব্যক্তি তার অধিকাংশ জৈবিক চাহিদা পূরণ করে এবং পরিবার ব্যক্তির সামাজিকীকরণের একটি অন্যতম মাধ্যম। 

পরিবার কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি

পরিবার বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি যে, বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক যৌথভাবে বসবাস করার একটি সংগঠন। আবার অনেকে মনে করেন যে, পরিবার যৌন সম্পর্ক দ্বারা গঠিত এমন একটি নির্দিষ্ট জুটি যা পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান করে সন্তান প্রসবের এবং প্রতিপালনের। অতএব স্বামী এবং স্ত্রীর বন্ধন দ্বারাই পরিবারের সৃষ্টি।

১) বংশ পরিচয় বিবেচনায় পরিবার

প্রাচীন যুগে বংশ পরিচয়ের ভিত্তিতে পরিবারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা:

ক) পিতৃতান্ত্রিক পরিবার (Patriarchal Family)

যে পরিবারে পিতা প্রধান থাকে তাকে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বলে। তাই হেনরি মেইনের মতে, “পিতৃতান্ত্রিক পরিবারই আদিম পরিবার।” 

খ) মাতৃতান্ত্রিক পরিবার (Matriarchal Family)

যে পরিবারে মাতা প্রধান থাকেন বা মাতার দিক থেকে বংশ পরিচয় দেওয়া হয় তখন তাকে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার বলে। 

২) বৈবাহিক প্রথার বিবেচনায় পরিবারের প্রকারভেদ

ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: 

ক) একপত্নীক পরিবার

যদি একজন পুরুষ একজন স্ত্রী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে, তবে তাকে একপত্নীক পরিবার বলে। 

খ) বহুপত্নীক পরিবার

যখন একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী বিবাহ করে পরিবার গঠন করে, তখন তাকে বহুপত্নীক পরিবার বলে।

গ) বহুপতি পরিবার

যখন একজন স্ত্রী একের অধিক স্বামী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে তখন তাকে বহুপতি পরিবার বলে।

৩) পারিবারিক কাঠামো বিবেচনায় পরিবারের প্রকারভের

পারিবারিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা: 

ক) একক পরিবার (Nuclear Family)

যখন একজন স্বামী ও একজন স্ত্রী তাদের ওপর নির্ভরশীল- সন্তান-সন্ততি নিয়ে  পরিবার গঠন করে তখন তাকে একক পরিবার বলে একক পরিবার ছোটো পরিবার।

খ) যৌথ পরিবার (যৌথ পরিবার)

যে পরিবারে দাদা-দাদি, বাবা-মা, চাচা-চাচি, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে ও অন্যান্যরা একসঙ্গে বসবাস করে, তাকে যৌথ পরিবার বলে।

পরিবারের বৈশিষ্ট্য, পরিবারের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি

১. বিশ্বজনীন অস্তিত্ব :- সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি স্তরে পরিবার ব্যবস্থার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ব্যবস্থাতেও বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে ; কিন্তু পরিবারের অস্তিত্ব সদা বর্তমান। সর্বকালে , বিশ্বের প্রতিটি সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবারবিহীন সমাজের অস্তিত্বের কথা কল্পনা করা যায় না। সুতরাং পরিবার হল একটি বিশ্বজনীন সংস্থা। 

২. ধারাবাহিকতা :- সমাজতত্ববিদেরা মনে করেন – সমাজ সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিবার ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। সমাজ পরিবর্তনশীল এবং সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি স্তরে পরিবার ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। তাই সমাজের ধারাবাহিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারেরও ধারাবাহিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পরিবার অবিরাম গতিতে পরিবর্তিত হয়ে তার ধারাবাহিক চরিত্র বজায় রেখেছে। 

৪. সম্পর্কের গভীরতা ও আবেগপূর্ণ ভিত্তি :- পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের নিবিড়তা পরিবারের অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। পরিবারের মধ্যে প্রতিটি সদস্য একে অপরের নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। স্নেহ ,ভালোবাসা , দায়িত্ব ,কর্তব্য – ইত্যাদি প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে অপরিহার্যরূপে যুক্ত থাকে। 

৫. স্বার্থহীন গোষ্ঠী :- পরিবার হল একটি স্বার্থবিহীন গোষ্ঠী। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সাধারণত স্বার্থের সম্পর্ক থাকে না। সকলে নিজ স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে পরিবারের স্বার্থের কথা চিন্তা করেন। যেমন মা – বাবা সম্পূর্ণরূপে স্বার্থহীন হয়ে সন্তানদের লালন – পালন করেন। একজন ব্যক্তি জন্ম থেকে মৃত্যু পরিবারের মধ্যেই তার জীবন অতিবাহিত করে। সদস্যদের স্বার্থত্যাগ , স্নেহ , ভালোবাসা ও দায়িত্ব – কর্তব্যের মধ্যে দিয়ে একটি পরিবার গঠিত হয়। 

৬. প্রাথমিক ও কেন্দ্রীয় গোষ্ঠী :- সমাজ গঠনের মূল একক হল পরিবার। বিভিন্ন পরিবারের সমন্বয়েই একটি সমাজ গঠিত হয়। তাই পরিবারকে প্রাথমিক গোষ্ঠী বলা হয়। এছাড়া পরিবার হল সকল সামাজিক সংগঠনের একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে পরিবার কেন্দ্রিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। 

৮. সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য :- প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে। পরিবারের সদস্যগণ তাদের সেই দায়িত্ব – কর্তব্য যথাযথভাবে পালন না করলে তা পরিবারের স্বার্থ বিঘ্নিত করে। তাই পারিবারিক শৃঙ্খলা ও পরিবারের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে স্ত্রী – পুরুষ , শিশু – বয়স্ক – সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। 

৯. সদস্যপদ :- পরিবারের সদস্যদের সদস্যপদ ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক উভয় প্রকার হয়ে থাকে। যেমন – পরিবারের মধ্যে শিশুর জন্ম হলে তার সদস্যপদ অনৈচ্ছিক ; কেননা পরিবারের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে তার ইচ্ছার কোনো ভূমিকা নেই। আবার বিবাহের ক্ষেত্রে সদস্যপদ ঐচ্ছিক। কেননা পাত্র – পাত্রী কোনো পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। 

১০. পরিবারের কার্যাবলী :- পরিবারের বিভিন্ন সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কার্যাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি পরিবার সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গঠন , সামাজিকীকরণ , সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ , অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা , সামাজিক অনুশাসন সৃষ্টি – ইত্যাদি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী।    

পরিবারের কার্যাবলি

পরিবারের সদস্যদের সুন্দর ও নিরাপদ জীবন গড়ে তােলার জন্য পরিবার বহুবিধ কাজ করে। পরিবার সাধারণত যেসব কার্য সম্পাদন করে, সেগুলাে নিম্নরূপ

১. জৈবিক কাজ :

আমাদের মা-বাবা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলেই আমরা জন্মগ্রহণ করেছি এবং তাদের দ্বারা লালিত-পালিত হচ্ছি। অতএব, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন করা পরিবারের অন্যতম কাজ। পরিবারের এ ধরনের কাজকে জৈবিক কাজ বলা হয়।

২. শিক্ষামূলক কাজ :

আমাদের মধ্যে অনেকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পূর্বেই পরিবারে বর্ণমালার সাথে পরিচিত হই । তাছাড়া মা-বাবা, ভাই-বােন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পারস্পরিক সহায়তায় সততা, শিষ্টাচার, উদারতা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলির শিক্ষা লাভের প্রথম সুযোেগ পরিবারেই সৃষ্টি হয়। এগুলাে পরিবারের শিক্ষামূলক কাজ। আর পরিবারে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বলে পরিবারকে শাশ্বত বিদ্যালয় বা জীবনের প্রথম পাঠশালা বলা হয় ।

৩. অর্থনৈতিক কাজ :

পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি চাহিদা পূরণের দায়িত্ব পরিবারের। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে এসব চাহিদা মিটিয়ে থাকে। পরিবারকে কেন্দ্র করে কুটির শিল্প, মৎস্য চাষ, কৃষিকাজ, পশু পালন ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ সম্পাদিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজের জায়গাগুলাে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়েছে এবং নতুন নতুন কাজের সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে। তবে আজও পরিবার আমাদের সকল প্রকার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করছে।

৪. রাজনৈতিক কাজ :

পরিবারে সাধারণত মা-বাবা কিংবা বড় ভাই-বােন অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে। আমরা ছােটরা তাদের আদেশ-নির্দেশ মান্য করে চলি। তারাও আমাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করেন । বুদ্ধি, বিবেক ও আত্মসংযমের শিক্ষা দেন, যা আমাদের সুনাগরিক হতে সাহায্য করে। এভাবে পারিবারিক শিক্ষা ও নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে পরিবারেই শিশুর রাজনৈতিক শিক্ষা শুরু হয়। এ শিক্ষা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় জীবনে কাজে লাগে। এছাড়া বড়দের রাজনৈতিক আলােচনা শুনে ও সে আলােচনায় অংশগ্রহণ করে আমরা দেশের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি।

৫. মনস্তাত্ত্বিক কাজ :

পরিবার মায়ামমতা, স্নেহ-ভালােবাসা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মানসিক চাহিদা পূরণ করে। নিজের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে ভাগাভাগি করে প্রশান্তি লাভ করা যায়। যেমন- কোনাে বিষয়ে মন খারাপ হলে মা-বাবা, ভাই-বােনদের সাথে আলাপ-আলােচনা করে তার সমাধান করা যায়। এ ধরনের আলােচনা মানসিক শান্তি-ক্লান্তি মুছে দিতে সাহায্য করে। তাছাড়া পরিবার থেকে শিশু উদারতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণগুলাে শিক্ষা লাভ করে, যা তাদের মানসিক দিককে সমৃদ্ধ করে।

৬. বিনােদনমূলক কাজ :

পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা, গান-বাজনা, টিভি দেখা, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বিনােদন লাভ করি। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে পরিবারের উল্লিখিত কাজগুলাে কিছুটা হ্রাস পেলেও সদস্যদের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনে পরিবারের এসব কাজের গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রতিটি পরিবারেরই কিছু সাধারণ একই ধরনের কার্যাবলি থাকে যা সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন। অর্থাৎ পরিবারের কিছু অপরিহার্য কার্যাবলি রয়েছে যার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। তাই পরিবারে এসব কার্যাবলি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এবং একটি পরিবারকে ঘিরেই এসব কাজ আবর্তিত হয় বা পরিবার এসব কাজ সম্পাদন করে। যেমন: 

  • ১. জৈবিক কাজ (Biological Function)
  • ২. মনস্তাত্বিক কাজ (Psychological Function)
  • ৩. অর্থনৈতিক কাজ (Economic Function)
  • ৪. শিক্ষামূলক কাজ (Educational Function)
  • ৫. রক্ষণাবেক্ষণ কাজ (Maintenance Function)
  • ৬. বিনোদনমূলক কাজ (Recreational Function)
  • ৭. ধর্মীয় কাজ (Religious Function)
  • ৮. সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ (Function of Social Control)
  • ৯. সাংস্কৃতিক কাজ (Cultural Function)
  • ১০. নিরাপত্তামূলক কাজ (ঝবপঁৎরঃরপধষ Function)
  • ১১. রাজনৈতিক কাজ (Political Function)
  • ১২. সামাজিকীকরণের কাজ (Function of Socialization)
  • ১৩. সামাজিক মর্যাদা বিষয়ক কাজ (Function Social Status)

পরিবারের গুরুত্ব

পরিবার (Family) হলো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান (Social Institution) এবং সমাজ কাঠামোর (Social Structure) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌল অঙ্গ সংগঠন। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবার হচ্ছে মানব সমাজের 

সবচেয়ে প্রাচীন, আদি, মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান (Institution)। তাই পরিবারকে সমাজের মুখ্য বা প্রাথমিক গোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। পরিবার হলো সমাজের কেন্দ্রবিন্দু।

মানব সমাজের উষালগ্ন থেকেই পরিবারের অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয়েছে। পরিবারবিহীন সমাজের চিত্র কল্পনা করা যায় না। আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সব সমাজেই পরিবার দৃষ্ট হয়েছে। হয়তো এর বিবর্তন ঘটেছে, রূপ বদলেছে কিন্তু সমাজে পরিবারের স্থায়ী আসন কখনো বিলুপ্ত হয়নি; পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ফুরায়নি। এর অন্যতম কারণ হলো মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানুষ একাকী থাকতে পারে না। স্বভাবতই মানুষ সঙ্গপ্রিয়। একে অন্যের পারস্পরিক সহযোগিতায় একত্রে মিলেমিশে বাস করতে চায় যা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট। এই সহজাত প্রবৃত্তিই মানুষকে পরিবার গঠনে ধাবিত করেছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষ পরিবারের আবহেই অবস্থান করে। 

পরিবারের মধ্যেই একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে, লালিত-পালিত হয়, বেড়ে ওঠে, শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়, কর্ম করে এবং এক সময় পরিবারের মধ্যেই সে মুত্যুবরণ করে। এমন কি মৃত্যুর পর তার শেষ কৃত্যের অনুষ্ঠান পর্যন্ত পরিবারের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। তাই বলা যায়, পরিবার একটি স্থায়ী ও সর্বজনীন (Universal) সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

পরিবার কী ধরনের শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান

অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে শিশুর শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে পরিবারের শিক্ষামূলক কাজগুলি আলােচনা করা হল一

(১) সামাজিক আচরণের শিক্ষা: পরিবার শিশুকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আচার-আচরণের শিক্ষা দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করতে করতে শিশু বিভিন্ন আচার-আচরণ শিখে ফেলে।

(২) সংস্কৃতির শিক্ষা: পরিবারই শিশুর মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায়। ফলে শিশুর মধ্যে সুস্থ সংস্কৃতির বােধ জাগ্রত হয়।

(৩) সু-অভ্যাস গঠনের শিক্ষা: পরিবার শিশুকে বিভিন্ন ধরনের সু-অভ্যাস গড়ে তুলতে শেখায়। ওই সু-অভ্যাসগুলিই পরবর্তীকালে শিশুকে সুনাগরিক হয়ে উঠতে সাহায্য করে।

(৪) প্রাক্ষোভিক বিকাশের শিক্ষা: পরিবার শিশুর প্রক্ষোভ-গুলিকে যথাযথভাবে বিকশিত হতে সাহায্য করে। সংযত প্রাক্ষোভিক আচরণের শিক্ষা শিশুর সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়।

(৫) জ্ঞানার্জনের শিক্ষা: পরিবার শিশুকে বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করে। জ্ঞানার্জনের শিক্ষা তাই প্রকৃতপক্ষে পরিবারেই শুরু হয়।

(৬) ঐতিহ্য সংরক্ষণের শিক্ষা: পরিবার শিশুকে সামাজিক ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিচিত করে এবং সেই ঐতিহ্য সংরক্ষণের শিক্ষা দেয়।

(৭) বৃত্তিশিক্ষা: শিশুকে বৃত্তিশিক্ষা দেওয়ায় পরিবার বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আজও বহু পরিবারে ছেলেরা বাবার বৃত্তি এবং মেয়েরা মায়ের বৃত্তি গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করে।

(৮) আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষা: পরিবার শিশুর মধ্যে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। শিশু নিজের অজান্তেই তার পরিবারের আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করে থাকে।

(৯) মূল্যবোধের শিক্ষা: শিশুর মধ্যে মূল্যবােধ গড়ে তােলার ক্ষেত্রে তার পরিবার বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন কাজ ও আচার-আচরণের মধ্য দিয়েই শিশুর মধ্যে মূল্যবােধ গড়ে ওঠে।

ওপরের আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিশুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক বােধ গঠনে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবার সঠিকভাবে এই কাজগুলি করতে না পারলে, শিশুর যথাযথ বিকাশ ব্যাহত হয়।

আরও পড়ুন: প্রাথমিক চিকিৎসা কি, প্রাথমিক চিকিৎসা কাকে বলে, প্রাথমিক চিকিৎসার জনক কে

সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা

পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিকীকরণের তাৎপর্যপূর্ণ বাহন। এর প্রধান কাজ হলো শিশুকে সৎ আচরণ এবং নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা দেয়া। পারিবারিক সুন্দর পরিবেশে শিশু যা গ্রহণ করে অন্য কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে সে তা করে না। শিশুকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র হলো সুগঠিত পরিবার। বস্তুত ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক- বেঠিক, সৎ-অসৎ ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিবার নামক অনানুষ্ঠানিক বিদ্যাগৃহেই শিক্ষা দেয়া হয়। অর্থাৎ একটি শিশুর সকল সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া গঠনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। নিম্নে শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা আলোচনা করা হলো:

ক. নবজাতকের উপর প্রভাব (Influence on newborn child)

নবজাত শিশুর পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে পরিবারে। পিতা-মাতার স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সে বেড়ে উঠে। পারিবারিক কাঠামোতে তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, মেধা ও মননের প্রতিফলন ঘটে এবং পরবর্তী জীবনে এগুলো সুস্পষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। কেননা কোন মানুষের পক্ষেই তার শৈশব জীবনের প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পরিবারেই শিশুর প্রথম মানসিক জগৎ তৈরি হয়।

খ. পারিবারিক পরিবেশ (Family environment)

সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো পারিবারিক পরিবেশ। পারিবারিক পরিবেশ অত্যন্ত খোলা-মেলা, প্রাণবন্ত এবং আত্মিক বিধায় শিশু অতি সহজে পরিবার থেকে অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করে থাকে। শিশু তার পরিবার থেকে যে আদর্শ, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ শিক্ষা লাভ করে থাকে সে হিসেবেই তার ভবিষ্যৎ জীনবভঙ্গি গড়ে উঠে। যে শিশু দুর্বল এবং ক্ষয়িষ্ণু পারিবারিক কাঠামোতে বেড়ে উঠে সে দুর্বল চিত্তের অধিকারী হয় এবং অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে। সুতরাং সমাজ আকাঙ্ক্ষিত ধারায় এবং সমাজের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে গড়ে উঠার জন্য সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেজন্য পরিবারকে শিশুর জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক সূতিকাগার বলা হয়।

গ. পরিবারের সাথে যোগাযোগ (Communication with the family)

পরিবারই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার সাথে কোন ব্যক্তির সম্পর্ক থাকে সুদৃঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী। শেকড়ের টান বা নাড়ীর টানকে কেউ সহজে ভুলতে পারে না। মানব শিশু যখন সমাজের সদস্য হিসেবে গড়ে উঠে তখন বিভিন্ন প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তার জীবনের উপর এগুলো বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তথাপি পরিবারের সাথেই মানুষ আমৃত্যু সম্পর্কযুক্ত থাকে।

ঘ. পরিবারের উপর নির্ভরশীলতা (Dependency on the family)

মানব শিশু জন্মগ্রহণের পর থেকেই পরিবারের উপর তার নির্ভরশীলতা শুরু হয়। তার এ নির্ভরশীলতার মাত্রা অত্যন্ত ব্যাপক এবং গভীর। তার এ নির্ভরশীলতা অন্তহীন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। পরিবারের মতো অন্য কোথাও শিশু এত নির্ভরশীল থাকে না। এখানেই সে তার জীবনের পরিপূর্ণতা উপলব্ধি করে এবং এখানেই সে খুঁজে পায় জীবনের পরিপূর্ণ প্রশান্তি। তাই ব্যক্তির জীবনে পরিবার হলো জনসম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।

ঙ. বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি (Creation of different opportunities)

পরিবার হলো ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের মিলন মেলা। এখানে মানব শিশু বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কের সাথে পরিচিত হয় এবং সমাজের আদর্শ, মূল্যবোধ, রীতিনীতি এবং কৃষ্টি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। সাম্যভিত্তিক নীতি-আদর্শ এবং সংগীত চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয় পারিবারিক কাঠামোতে। বস্তুত মানব শিশুর সমষ্টি জীবনের প্রথম পাঠ লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয় পরিবার নামক বিদ্যাগৃহেই। এ কারণে সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

চ. বৃহত্তর সমাজের সাথে পরিচিতি (Introducing with the large society)

পরিবারের মধ্য থেকেই শিশুর বৃহত্তর সমাজের সাথে পরিচিতির দ্বার উন্মোচিত হয়। পরিবারেই শিশু বিভিন্ন আচার-আচরণ ও রীতিনীতিতে অভ্যস্ত হয় এবং বিভিন্ন চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়, যা পরবর্তীতে বৃহত্তর সমাজের সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়। বৃহত্তর সমাজে অনুপ্রবেশের জন্য যে মৌল গুণাবলির প্রয়োজন তা পারিবারিক কাঠামোতেই অর্জন করা হয় এবং বৃহত্তর সমাজের সাথে সামিল হওয়ার ছাড়পত্র পরিবার থেকেই সে পেয়ে থাকে।

ছ. ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব (Influence on personality)

পরিবার হলো ব্যক্তিত্ব গঠনের কেন্দ্রস্থল। যে শিশু সুদৃঢ় পারিবারিক কাঠামোতে জন্মগ্রহণ করে এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পিতা-মাতার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠে সে শিশু ক্রমে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সমাজে মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়। শিশু অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবে নাকি বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবে কিংবা উভয়মুখী ব্যক্তিত্বের (Ambivert personality) অধিকারী হবে তা পরিবারেই নির্ধারিত হয়। পরিবারের মধ্যে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। মানব শিশু তার পরিবার পরিজনদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে। ফলে শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবারের প্রভাব প্রতিক্রিয়া কার্যকর থাকে।

জ. মর্যাদা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি (Creation of status and security feeling)

মানব শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন সে থাকে অত্যন্ত অসহায়। তখন পরিবারই তাকে নিরাপত্তা বিধান করে এবং পরিবারের পরিচিতির ভিত্তিতেই তার সামাজিক মর্যাদা নিরূপিত হয়। পরিবারের মধ্যে বসবাস করে ব্যক্তি তার অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে প্রথম অবস্থায়ই সচেতন হয়ে উঠে এবং এ সচেতনতার মধ্য দিয়েই তার সামাজিক নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি হয়।

ঝ. মানসিক চাহিদার পরিতৃপ্তি সাধন (Meet up of mental needs)

পরিবারের গণ্ডিতেই শিশু তার সকল প্রকার মানসিক চাহিদার পরিতৃপ্তি সাধন করে থাকে। প্রত্যেক শিশুই ভালো কাজের পুরস্কারস্বরূপ পরিবার থেকেই প্রশংসা পেতে চায় এবং এই প্রশংসার স্বীকৃতিই তাকে অধিকতর ভালো কাজের প্রেরণা জোগায়। এই আকাঙ্ক্ষা শৈশব এবং কৈশোরে আরো ক্রিয়াশীল থাকে এবং মানসিক চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটলে সে সমাজের একজন কাঙ্ক্ষিত সদস্য হিসেবে সকলের নিকট প্রতিভাত হয়।

ঞ. সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা (Learning of social values)

প্রত্যেক সমাজে প্রচলিত এবং স্বীকৃত কিছু মূল্যবোধ আছে, যা পারিবারিক কাঠামোতে চর্চা হয়ে থাকে। পরিবার থেকেই শিশু এ মূল্যবোধ আত্মস্থ করে এবং সমাজের উপযোগী সদস্য হিসেবে গড়ে উঠে।

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, একটি শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা অনেক। পরিবারই হলো শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম ও প্রধান মাধ্যম। তাই শিশু পরিবার থেকে যা কিছু শিখে, পরবর্তীতে তার আচরণে তা প্রতিফলন ঘটে।

বৈদিক সমাজে পরিবারের প্রধান কে ছিলেন

রাষ্ট্রের মতো বৈদিক সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার এবং তা ছিল পিতৃপ্রধান। পরিবারের প্রধান ছিলেন পিতা বা পুরুষ। তিনি গৃহপতি বা দম্পতি নামে পরিচিত ছিলেন। পরিবারভুক্ত সদস্যদের ওপর তার ক্ষমতা ছিল সীমাহীন। 

একক পরিবার ও যৌথ পরিবারের মধ্যে পার্থক্য

আধুনিক যুগে সমাজবিজ্ঞানীগণ পরিবারকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন কারণ কোন পরিবার যখন সমাজে একটি সংগঠন হিসেবে বিরাজমান তখন সেই পরিবারকে যৌথভাবে অন্যান্য পরিবারের (অবশ্য একই রক্ত সম্পৰ্কীয়) সাথে একত্রে বসবাস করতে দেখা যায়। আবার শুধু স্বামী–স্ত্রী ও তাদের সন্তান সন্ততিসহ বাস করতে দেখা যায়। এ পর্যায়ে সংখ্যা ও সদস্য অনুযায়ী পরিবারের প্রকারভেদ লক্ষ করা যায়; যেমন– একক পরিবার (Nuclear family) ও যৌথ পরিবার ( Joint family)।

একক পরিবার কাকে বলে

একক পরিবার বলতে আমরা বুঝে থাকি যখন একজন পুরুষ তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পৃথকভাবে বসবাস করে। একক পরিবার স্ত্রী ও সন্তান সন্ততি সমবায়ে গঠিত হয়ে থাকে। একক পরিবার চিরন্তন সামাজিক দৃষ্টির বিষয়ীভূত সংগঠন।

মূলত আমরা দেখতে পাই যে, এই একক পরিবার থেকেই সকল প্রকার পরিবারের উদ্ভব হয়েছে এবং যে কোন পরিবার স্ত্রী ও পুরুষকে নিয়ে গঠিত হয়। আধুনিক যুগে একক পরিবারের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকের মতে এর কারণ হচ্ছে আধুনিক ব্যক্তিবাদ বা Individualism এর ক্রিয়াশীলতা।

এছাড়াও আধুনিক শিল্পোন্নত দেশগুলোতে একক পরিবারের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে চলেছে। এর উৎপত্তির আরো একটি কারণ হচ্ছে পরিবারের দায়িত্ব ক্রমবর্ধমানভাবে রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত হচ্ছে। ব্যক্তি পূর্বের ন্যায় আর পরিবারের উপর ও পরিবারের সদস্যের উপর নির্ভরশীল নয়। পরিবারের অনেক দায়িত্বই রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মারফত সমাধা হয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন একক পরিবার সার্থকভাবে পাশ্চাত্য দেশে গড়ে উঠেছে। আধুনিক স্বাধীন একক পরিবারের সংহতি মূলত যৌন আকর্ষণ ও স্বামী–স্ত্রীর সাহচর্যের এবং তাদের সন্তান–সন্ততিদের সাহচর্যের উপর নির্ভরশীল।

বিশ্বের যে দেশগুলোতে শিল্প এবং যান্ত্রিকতার প্রসার ঘটেছে সেসব দেশে সহজাতভাবেই একক পরিবার গড়ে উঠেছে। কারণ শিল্প–কারখানায় কাজ করায় শ্রমিকগণ ঘরছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে। কোন কোন শ্রমিককে গ্রাম ছেড়ে নগরে কাজে আত্মনিয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে যৌথ পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্রভাবে নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে আলাদা পরিবার গঠন করতে হচ্ছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মৌলিক কারণ হচ্ছে শিল্পায়ন, নতুন নতুন নগর, শহর ও বন্দরের পত্তন এবং শিক্ষার প্রসারতার সাথে সাথে চাকরিজীবীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ।

যৌথ পরিবার কাকে বলে

যে পরিবার বৃদ্ধ পিতামাতা, ভাইবোন, স্ত্রী ও সন্তান–সন্ততিসহ একত্রে বসবাস করে তাকে যৌথ পরিবার বলে। একক পরিবারের মতো কেবল স্বামী–স্ত্রী এবং তাদের সন্তান–সন্তুতিই যৌথ পরিবারের সদস্য নয়– যৌথ পরিবারের ব্যাপ্তি আরো ব্যাপক। যৌথ পরিবারের ধর্ম ও সম্পত্তি এক। যৌথ পরিবারের বন্ধন দৃঢ় হওয়ার পিছনে পরিবারের কর্তার বা পিতার বিষয়–সম্পত্তি একটি প্রধান বিষয়। যৌথ পরিবার অনুন্নত সমাজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক লোককে যৌথ পরিবারে ক্ষমতা অনুযায়ী গ্রহণ এবং প্রত্যেক লোককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রদান– এ নীতির ভিত্তিতে যৌথ পরিবার পরিচালিত হয়।

বিশেষকরে, কৃষিভিত্তিক প্রসারতা, নগরের পতন ও ব্যক্তিস্বার্থ প্রসারের সাথে সাথে যৌথ পরিবারে ভাঙন শুরু হয়েছে। এছাড়াও কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ও শিক্ষা প্রসারের ফলে যৌথ পরিবারের প্রয়োজনীয়তা লোপ পাচ্ছে।

যৌথ পরিবার অনুন্নত দেশ ও কৃষিভিত্তিক সমাজে বিশেষ ফলপ্রসূ হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক যুগে যান্ত্রিক ও শিল্পোন্নত হওয়ার ফলে পারিবারিক যৌগ ব্যবস্থা টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আর সে কারণেই উন্নতশীল ও উন্নয়নকামী দেশগুলোতে বিশেষকরে শিল্পোন্নত সমাজে এর ভাঙন দেখা যাচ্ছে এবং একক পরিবারের প্রাধান্য বেড়ে যাচ্ছে।

আরো অন্যান্য সরকারি স্কিম সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | পরিবার

Q1. একান্নবর্তী পরিবার কাকে বলে

Ans – যারা এক পরিবারে একই সাথে খাবার খায় বা যৌথ সংসারের অন্তর্ভুক্ত তাদেরকে একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য বলা হয়। একান্নবর্তী পরিবার হল যৌথ পরিবার যেখানে মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, দাদু, ঠাকুমা, কাকা, কাকিমা, জেঠু, জেঠিমা, তাদের ছেলে- মেয়ে সবাই থাকে।

Q2. মাতৃতান্ত্রিক পরিবার কাকে বলে

Ans – মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হচ্ছে সেসব পরিবার বা জনগোষ্ঠী, যাদের পরিবারের দায়িত্ব থাকে একজন নারীর ওপর এবং বংশের ধারাও নির্ধারিত হয় নারীর দিক থেকে। মায়ের পরিবার থেকেই উত্তরাধিকার ও বংশ-পদবি নির্ধারিত হয়। প্রজন্মে পর প্রজন্ম এ ব্যবস্থায় মাতৃগোত্রীয় বংশাণুক্রমিক ধারা অব্যাহত থাকে। প্রাচীনকাল থেকে মাতৃতান্ত্রিক ধারার কিছু জনগোষ্ঠী অদ্যাবধি জীবনধারণ করছে।

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।