নবম শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

সূচিপত্র

চিপকো আন্দোলনের নেতা কে, চিপকো আন্দোলনের নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন

স্থানীয় সংস্থা Dashauli Gram Swarajya Sangh (DGSS) ১৯৭৩ সালে স্থানীয় মানুষদের কৃষি সরঞ্জাম তৈরির জন্য বন দপ্তরের কাছে ১০ টি করে ছাই বৃক্ষ প্রদানের অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু বনদপ্তর তা দিতে অগ্রাহ্য করেন পরিবর্তে তারা বিদেশী সাইমন্ড কোম্পানীকে ৩০০ টি  ছাই বৃক্ষ প্রদানের অনুমতি প্রধান করে। যা স্থানীয় মানুষদের মধ্যে অসন্তোষের উদ্ভব ঘটায়। তারপর ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সাইমন্ড কোম্পানীর কিছু কর্মচারী তাদের বরাদ্দ ৩০০ বৃক্ষ কাটতে এলে স্থানীয় মানুষ জন ড্রাম বাজিয়ে, লোকগীত গেয়ে তাদের বিরোধীতা করেন।

পরবর্তী সময়ে হিমালয় অঞ্চলে বৃক্ষচ্ছেদনকে সম্পূর্ন রূপে বন্ধ করার জন্য ১৯৮১ সালে এপ্রিল মাসে চিপকো আন্দোলনের অপর এক নেতা সুন্দরলাল বহুগুনা আমরন অনশনে বসেন। তার ফলস্বরূপ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ডিরা গান্ধী সুন্দরলাল বহুগুনার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং হিমালয় অঞ্চলে ১৫ বছরের জন্য বানিজ্যিক ভাবে বৃক্ষচ্ছেদন সম্পূর্নরূপে নিষিদ্ধ করে দেন। এভাবে চিপকো আন্দোলন ধাপে ধাপে সফলতার দিকে এগিয়ে যায়। সবশেষে বলা যেতে পারে চিপকো আন্দোলন পরিবেশ আন্দোলনের চেয়ে মানুষের বেঁচে থাকার আন্দোলন হিসাবে বেশি পরিচিত এবং এই আন্দোলনে নারী সমাজের অংশ গ্রহন অন্যতম গুরুত্বপূর্ন একটি দিক। 

অসহযোগ আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল, অসহযোগ আন্দোলনের ফলাফল

অসহযোগ আন্দোলনের কারণ

১. স্বায়ত্তশাসন অর্জনে ব্যর্থতা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসন দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল । তাই প্রবল আশা নিয়ে ভারতবাসী ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধ তহবিল গঠনের জন্য ছ-কোটি একুশ লক্ষ পাউন্ড চাঁদা দেয়। এ ছাড়াও প্রায় সাড়ে বারো লক্ষ ভারতীয় সেনা ইংরেজদের হয়ে বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। কিন্তু যুদ্ধশেষে ব্রিটিশ তার স্বায়ত্বশাসন দানের প্রতিশ্রুতি অমান্য করে। তাই আশাহত ভারতবাসী আন্দোলনের পথে যায়।

২. আর্থিক সমস্যা: যুদ্ধজনিত কারণে ভারতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ে। কিন্তু সেই অনুপাতে কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ ভারতবাসীর আয় না বাড়ায় তারা সমস্যায় পড়ে। এই আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ভারতবাসী গণ আন্দোলনে সাড়া দেয়।

৩. রাওলাট আইন: ব্রিটিশ ভারতবাসীর ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ ও ন্যায়বিচারের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য কুখ্যাত রাওলাট আইন (১৯১৯ খ্রি. ১৮ মার্চ) পাস করায়। এই আইনে বলা হয়, যে-কোনো ভারতীয়কে সন্দেহের বশে বিনা পরওয়ানায় গ্রেপ্তার বা বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা যাবে। এই আইন ভারতবাসীকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

৪. জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড: রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য পাঞ্জাবের অমৃতসর জেলার জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ডাকা হয়। এই সমাবেশে উপস্থিত জনতার ওপর ডায়ারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনারা নিষ্ঠুরভাবে গুলি চালায়। এতে প্রচুর সংখ্যক নিরপরাধী নারী, বৃদ্ধ ও শিশুর মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেন ও ব্রিটিশের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন।

অসহযোগ আন্দোলনের ফলাফল বা তাৎপর্য

১. রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ: অসহযোগ আন্দোলন ভারতীয় রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অসহযোগ আন্দোলন ভারতবাসীর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করেছিল।

২. কংগ্রেসের প্রভাববৃদ্ধি: অসহযোগ আন্দোলন জাতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসের মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়েছিল। এই আন্দোলনের পর সুদূর গ্রামগুলিতেও জাতীয় কংগ্রেসের শাখা-প্রশাখা গড়ে উঠতে শুরু করে। ফলে জনমানসে কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। 

৩. গান্ধিজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা: অহিংস পথে অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ফলে জাতীয় রাজনীতিতে গান্ধিজির প্রভাব-প্রতিপত্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। জাতির নেতা হিসেবে গান্ধিজি সারা ভারতে পরিচিতি পান

৪. আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি: অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে খাদি বস্ত্রশিল্পসহ বিভিন্ন দেশীয় শিল্পের প্রসার ঘটে। এই আন্দোলনে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ যোগ দেওয়ায় জাতপাতের ভেদরেখা অনেকটাই মুছে যায়। এই আন্দোলনের সুফল হিসেবে বেশ কিছু দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ

ই আন্দোলনের পশ্চাতে নানা কারণ ছিল। যেমন –

(১) ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা

ক্রিপসমিশন ব্যর্থ হলে সারা ভারত ক্ষোভে রোষে ফেটে পড়ে। ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে ইংরেজ সরকার কোনো অবস্থাতেই ভারতবাসীর সঙ্গে সমঝোতায় এসে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তারা বুঝতে পারে যে, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ব্যতীত ইংরেজদের কাছ থেকেকিছু আদায় করা সম্ভব নয়।

(২) জাপানের অগ্রগতি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের চমকপ্রদ সাফল্য এবং সিঙ্গাপুর, মালয় ও ব্রহ্মদেশে ইংরেজদের শোচনীয় পরাজয় ভারতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে, ভারতে জাপানি আক্রমণ আসন্ন এবং তা প্রতিহত করার কোনো ক্ষমতাই ইংরেজদের নেই—ভারতে ইংরেজদের দিন শেষ হয়ে এসেছে।

৩) ভারতীয় সেনাদের ক্ষোভ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ব্রহ্মদেশে কর্মরত আহত, অসুস্থ ও অভুক্ত ভারতীয় সেনারা কর্মচ্যুত হয়ে এই সময় ভারতে ফিরতে থাকে। জাপানিদের হাতে ভারতীয় সেনাদের পরাজয় এবং তাদের প্রতি ইংরেজদের হৃদয়হীন আচরণ ভারতবাসীকে ক্ষুব্ধ করে। এই মানসিকতা থেকেই ভারতে ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ-জন সোনা, রূপা ও টাকা-পয়সা মজুত করতে থাকে।

(৪) দক্ষিণ-পূর্বএশিয়ায় ভারতীয়দের প্রতি অবহেলা

ব্রিটিশ শাসনাধীন মালয় ও ব্রহ্মদেশে বহু ভারতীয় বাস করত। জাপানিদের হাতে পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীদের জাহাজে করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেলেও, কৃষ্ণকায় ভারতীয়দের সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়। ইংরেজদের এই বিশ্বাসঘাতকতায় ভারতীয়রা প্রবল ক্ষুব্ধ হয়।

(৫) ভারতীয়দের শোচনীয় অবস্থা

  • (ক) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়রা ভারতে তাদের আত্মীয়দের কাছে যে-সব চিঠি-পত্র লিখতেন সেগুলিতে ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতা ও তাঁদের শোচনীয় দূরবস্থার কাহিনীতে পূর্ণ থাকত।
  • (খ) এই সব অঞ্চলের লাখ লাখ ভারতীয় নদ-নদী, জঙ্গল অতিক্রম করে পায়ে হেঁটে চরম দুর্দশার মধ্যে ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। পথে অনেকের মৃত্যু হয়, বর্মী ও আরাকানী দস্যুরা অনেকের যথাসর্বস্ব লুঠ করে এবং অনেককে হত্যা করে।
  • (গ) এইভাবে চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিঃস্ব, রিক্ত শরণার্থীর দল ভারতে পৌঁছায়। ভারতবাসী বুঝতে পারে যে, জাপান ভারত দখল করলে তাদেরও এই অবস্থা হবে।

(৬) ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি

যুদ্ধকালীন করভার, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির তীব্র সংকট এবং ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি ভারতবাসীকে প্রবল সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। ১৯৪১-এ শস্যের দাম ১৯৪০ এর তুলনায় ১৩.৫% বৃদ্ধি পায়। বাংলায় খুচরো চালের দাম মণ প্রতি ৩০-৫০ টাকায় পৌঁছায়। কাপড়, কেরোসিন এবং ওষুধপত্র দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য হয়ে ওঠে।

(৭) কালো বাজারি

মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে শুরু হয় মজুতদারি, কালোবাজারি ও ফাটকাবাজি। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষ ইংরেজ শাসনের প্রতি যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয় এবং এই অপশাসনের অবসান কামনা করে।

(৮) সেনাদলের অত্যাচার

যুদ্ধ উপলক্ষে ভারতে বিপুল সংখ্যক ইংরেজ, মার্কিন ও অস্ট্রেলিয় সৈন্যের উপস্থিতি, ‘কালা আদমী’ ভারতীয়দের প্রতি তাদের উদ্ধত আচরণ এবং ভারতীয় নারীদের প্রতি অশালীন আচরণ ভারতবাসী ভালভাবে নেয় নি। জাতীয় কংগ্রেস এই ব্যাপারে বারংবার প্রতিবাদ জানালেও কোন সুরাহা হয়নি।

(৯) সাধারণ মানুষের ক্ষোভ

  • (ক) জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সরকার বাংলা, আসাম ও উড়িষ্যায় যে “পোড়ামাটি” নীতি অনুসরণ করে তাও দেশবাসীর অসন্তোষে ঘৃতাহুতি দেয়।
  • (খ) এই সব অঞ্চলের গ্রামগুলি থেকে সরকার বলপূর্বক সাইকেল ও নৌকা দখল করে ধ্বংস করেফেলে। সরকারের আশঙ্কা ছিল যে জাপানিরা এগুলি ব্যবহার করে গ্রামের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়বে।
  • (গ) সেই সময় গ্রামাঞ্চলের মানুষদের যাতায়াতের বাহন ছিল এই দু’টিই। পূর্ববঙ্গে বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া চলাচল অসম্ভব ছিল। এই সব কারণে সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

(১০) জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা

  • (ক) জাপানি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে এই ধারণা জন্মায় যে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য এবং এই অবস্থায় আর নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা উচিত নয়। এই কারণেই তারা গভীর আগ্রহ নিয়ে ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাবের দিকে লক্ষ্য রাখছিল।
  • (খ) ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, এই সময় ভারতীয় নেতৃবৃন্দ একটি বিশেষ কারণে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম শুরু করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি বলেন যে, এই সময় নানা কারণে জনগণের মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন যে জাপানিরা ভারত দখল করলে জনগণ হয়তো কোন বাধাই দেবে না।
  • গ) তিনি আরও বলেন যে, তারা যাতে জাপানি আগ্রাসন প্রতিহত করতে পারে এই উদ্দেশ্যে জনগণের হতাশা কাটানো এবং নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস আনার উদ্দেশ্যেই নেতৃবৃন্দ সংগ্রামের কথা চিন্তা করেন।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ফলাফল

ভারত ছাড়ো আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলনের নানা গুরুত্ব ছিল সেগুলি হল-

1. আন্দোলনের ব্যাপ্তি : সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। কৃষক শ্রমিক , নারী – পুরুষ, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সকলের যোগদানের ফলে এটি প্রকৃত অর্থে গণ আন্দোলনে পরিণত হয় । জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে সম্পাদিত ‘ The Indian Nation in 1942 ‘ গ্রন্থে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে জাতীয়তাবাদী গণ আন্দোলন বলে অভিহিত করা হয়েছে।

2. স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন : ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত এবং তা অর্জনের জন্য তারা সব ধরনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা – এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। ড. অম্বাপ্রসাদ বলেছেন, “ 1942 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা 1947 খ্রিস্টাব্দের ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুত করে। ”

3. ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি : ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রমাণ করে যে, মুক্তিসংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য। বড়োেলাট লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ সরকারকে লেখেন, “ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দিন শেষ হয়েছে। পুনরায় এই ধরনের আন্দোলন হলে তা মোকাবিলা করার ক্ষমতা সরকারের নেই। ”

4. কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধি : ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে , জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে 42 এর আন্দোলন হল চূড়ান্ত পর্যায়। কংগ্রেসের ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শামিল হয়। ফলে জনমানসে কংগ্রেসের প্রভাব আরও জোড়ালো ও সর্বাত্মক হয়।

5.সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার : মুসলিম লিগ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলেও উত্তরপ্রদেশ, বিহার, চট্টগ্রাম, শিলচর – সহ বহু স্থানের মুসলমানগণ এই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং আন্দোলনে নানাভাবে সহায়তা করে। ফলে হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য যে, এইসময় কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি।

ঊষা মেহতা কোন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন

ঊষা মেহতা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ।

বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী উষা মেহতার নাম অনেকেই শুনেছেন। উষা মেহতা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমনকি তিনি কংগ্রেজ রেডিয়োর অন্যতম সদস্য ছিলেন। উষা মেহতা ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের। 

ঊষা মেহতার স্বদেশপ্রেম এতটাই উঁচু তারে বাঁধা ছিল যে ইংরেজেদের দেওয়া বিদেশে পড়াশুনোর প্রস্তাব তিনি নাকচ করতে তিনি দ্বিতীয়বার ভাবেননি। ভারত সরকার তাঁকে ১৯৯৮-এ পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত করে।

আইন অমান্য আন্দোলনের কারণ ও গুরুত্ব

আইন অমান্য আন্দোলনের কারণ

আইন অমান্য আন্দোলনের পশ্চাতে বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন –

(ক) অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব

  • (১) অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ভারতীয় জন-জাগরণের ইতিহাসে এর গুরুত্ব ছিলঅপরিসীম। এই আন্দোলন দেশের অভ্যন্তরে এক প্রবল রাজনৈতিক জাগরণের সূচনা করে। এবং দেশবাসীর অন্তরেও প্রবল আশার সঞ্চার হয়।
  • (২) জনসাধারণ যে কোনো মূল্যে তাদের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য প্রস্তুত ছিল‌।নেতৃমণ্ডলীর পক্ষেও এই অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতি উদাসীন থাকা সম্ভব ছিল না। সুতরাং বলা চলে যে, অসহযোগ আন্দোলনের গর্ভেই নতুন আন্দোলনের বীজ নিহিত ছিল।

(খ) স্বরাজ্য দলের ব্যর্থতা

  • (১) গান্ধীজির অসহযোগ নীতির বিরুদ্ধে সরকার-বিরোধী মানসিকতা নিয়েই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে ‘স্বরাজ্য দল’ গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল আইনসভায় প্রবেশ করে সরকারি কাজে ‘নিরন্তর বাধার সৃষ্টি করেসরকারকে অচল করে দেওয়া।
  • (২) বাস্তবে কিন্তু তা হয় নি। গভর্নর ও গভর্নর জেনারেল বিশেষ ক্ষমতাবলে ঐ সব বাধা অতি সহজেই অতিক্রম করে যান।
  • (৩) দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর ‘স্বরাজ্য দল’-এ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে, স্বরাজীরা নানা প্রলোভনের শিকার হন এবং অনেকেই আবার কংগ্রেসের মূল স্রোতে ফিরে আসেন। ‘স্বরাজ্য দল’ জাতির আশা পূরণে ব্যর্থ হয়।

(গ) কংগ্রেসের গঠনমূলক কার্যাবলী

  • (১) অসহযোগ আন্দোলনের পর কট্টর গান্ধীবাদীরা গ্রাম সংগঠন, হরিজন আন্দোলন, খাদির প্রচার, মাদক বর্জন প্রভৃতি গঠনমূলক কাজ চালিয়ে যান। তাঁদের উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয় বিদ্যালয়, খাদি প্রতিষ্ঠান ও গান্ধী আশ্রম গড়ে ওঠে।
  • (২) এইভাবে গান্ধীজির ভাবধারা ভারতের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষক-মজুর ও হরিজন সম্প্রদায় গান্ধীবাদীদের কাছের মানুষে পরিণত হয়। এইভাবে জাতীয় কংগ্রেস জনসাধারণের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়।

(ঘ) হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা

  • (১) অসহযোগ আন্দোলনের পর সারা দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং দেশের নানা স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কোহাটের দাঙ্গায় ১৫৫ জন অ-মুসলিম নিহত হয়। ১৯২৫-এ ১৬টি এবং ১৯২৬-এ ২৫টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়।
  • (২) ১৯২৬-এ এক ধর্মান্ধ মুসলিমের হাতে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ নিহত হন। ধর্মান্ধ হিন্দুরাও বসে ছিল না। তারা ‘শুদ্ধি’, ‘সংগঠন’, গোহত্যা-বিরোধী আন্দোলন, উর্দুর বিরোধিতা প্রভৃতির মাধ্যমে নিজেদের কর্মধারা অব্যাহত রাখে।
  • (৩) ইংরেজ সরকারও এই বিরোধে নানা ভাবে উস্কানি দিতে থাকে। উত্তরপ্রদেশের ছোটলাট হারকুট বাটলার বড়লাট লর্ড রিডিং-কে লেখেন যে, “হিন্দু মুসলিমরা পরস্পরকে ঘৃণা করতে এত ব্যস্ত যে, আমাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের মত সময় তাদের হাতে নেই।”
  • (৪) জাতীয় জীবনের এই অন্ধকারময় দিনে গান্ধীজি উপলব্ধি করেন যে, পরস্পরকে ঐক্যবদ্ধ করে গঠনমূলক কর্ম বা জাতীয় আন্দোলনে সামিল করতে না পারলেএই হিংসাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ হবে না। এই উদ্দেশ্যে তিনি একুশ দিন অনশন করেন (১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৪)।

(ঘ) হরিজন আন্দোলন

  • (১) হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের লোকদের প্রতি উচ্চবর্ণের অবিচার ও অনাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ওঠে। বিহারের যাদব সম্প্রদায় উচ্চবর্ণের ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • (২) বিখ্যাত কৃষক নেতা স্বামী সহজানন্দ ভূমিহার ও ব্রাহ্মণ বিরোধী সংগঠন গড়ে তোলেন। মহারাষ্ট্রের সত্যশোষক আন্দোলন -ও ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও ব্রাহ্মণ-বিরোধী।
  • (৩) ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর হরিজন ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মুখপাত্র হিসেবে আইনসভায় হরিজন ও অস্পৃশ্য শ্রেণীর জন্য আসনসংরক্ষণ ও পৃথক নির্বাচনের দাবি জানান। এছাড়াহরিজনদের জন্য পানীয় জলের কূপ, পুষ্করিণী ব্যবহার এবং মন্দিরে প্রবেশের অধিকার দাবি করা হয়।
  • (৪) মানবতার প্রতীক গান্ধীজি হরিজনদের পক্ষে এগিয়ে আসেন। তিনিই তাদের ঈশ্বরের সন্তান বা ‘হরিজন’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, হরিজনদের প্রতি অবহেলা করলে হিন্দুধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে।
  • (৫)  হরিজনদের প্রতি গান্ধীজির মনোভাব তাদের আস্থা অর্জনে সাহায্য করে এবং আইন অমান্য আন্দোলনে গান্ধীজি তাদের ব্যাপক সহায়তা পান। গান্ধীজি উপলব্ধি করেন যে, ভারতে যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ চলেছে তা বন্ধ করার জন্য এক্ষুনি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম শুরু করা উচিত।

(চ) কৃষকদের দুর্দশা

  • (১) ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে যে বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দেয় তার ফলে ভারতীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মন্দার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় কৃষিজাত পণ্যের চাহিদা ও মূল্য বিপুল পরিমাণে হ্রাস পায়, কিন্তু ভারতে আমদানিকৃত শিল্পজাত পণ্যের মূল্য সে তুলনায় হ্রাস পায় নি।
  • (২) এর প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে শুভপ্রদ হয় নি। এই সময় ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও শিল্পজাত পণ্যের তুলনায় কৃষি-পণ্যের মূল্য প্রবলভাবে হ্রাস পায়। কৃষক তার পণ্য বিক্রি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল্পজাত দ্রব্যাদি ক্রয় করত।
  • (৩) এছাড়া, কৃষককে আবার সরকারের কর, জমিদারের খাজনা এবং মহাজনের সুদ মেটাতে হত। এই সব কারণে কৃষককে এক সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এই অবস্থায় বিভিন্ন কৃষক সভাগুলি এবং কমিউনিস্টরা কৃষকদের পক্ষে আন্দোলনে নামে। কৃষকদের শোচনীয় দুর্দশা আইন অমান্য আন্দোলনের অন্যতম কারণ।

(ছ) শ্রমিক আন্দোলন

  • (১) বেতন হ্রাস, শ্রমিক ছাঁটাই, লক আউট প্রভৃতির প্রতিবাদে ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেও তখন প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়। ভারতে তখন এমন কোনো শিল্প ছিল না, যাতে শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে নি।
  • (২) ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অংশগ্রহণের ফলে ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে খড়্গাপুর রেল কারখানায় ধর্মঘট, ১৯২৮-এ লিলুয়ায় রেল ধর্মঘট, বাংলার পাটশিল্প এবং বোম্বাই-এর বস্ত্রশিল্পে ধর্মঘট অতি উল্লেখযোগ্য।
  • (৩) সরকারি অত্যাচার, এমনকী গুলিচালনা সত্ত্বেও ধর্মঘটীরা তাদের দাবিতে অবিচল ছিল। এক কথায়, এই সময় দেশে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার আমদানি, কমিউনিস্ট ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে শ্রমিক-মজুর ও কিষাণদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে নানা দমন-পীড়ন দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
  • (৪) কেবলমাত্র এই নয়, ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণীও সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। সরকারের অসম বাণিজ্যনীতিতে তারা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তারা উপলব্ধি করে যে, প্রকৃত ‘স্বরাজ’ ব্যতীত ইংরেজ পুঁজিপতিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পারা যাবে না।

(জ) যুব আন্দোলন

  • (১) ভারতীয় যুব সমাজও সেদিন চঞ্চল ও অশান্ত হয়ে উঠেছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন যুব সংগঠন, যুব লীগ ও যুব সমিতি। তরুণ জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু সেদিন যুব সমাজের আদর্শে পরিণত হয়েছেন।
  • (২) তাঁদের কণ্ঠে সেদিন ধ্বনিত হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, ধনতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রবিরোধী বক্তব্য। সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন যুব সম্মেলনে তাঁরা ভাষণ দিচ্ছেন। লাহোরে প্রতিষ্ঠিত হয় নওজোয়ান ভারত সভা।
  • (৩) জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ভারতীয় জাতীয়তা বাদী আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’-এর কথা বললে জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র ‘ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেণ্ডেস লীগ’ গঠন করে ‘পূর্ণ স্বাধীনতার’ পক্ষে প্রচারে নামেন। গান্ধীজি উপলব্ধি করেন যে, আর দেরি করলে যুব সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।

(ঝ) বিপ্লবী আন্দোলন

  • (১) ভারতীয় বিপ্লবীরাও তখন যথেষ্ট সক্রিয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করে গোপীনাথ সাহা ফাঁসিতে প্রাণ দেন।
  • (২) ১৯২৫ সালের আগস্ট মাসে উত্তরপ্রদেশের বিপ্লবীরা কাকোরীতে ট্রেন ডাকাতি করে সরকারি টাকা লুঠ করেন। এই উপলক্ষে শুরু হয় কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা।
  • (৫) ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লীর কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের অধিবেশনে বোমা নিক্ষেপ করেন (৮ই এপ্রিল, ১৯২৯)। দীর্ঘ ৬৩ দিন অনশনের পর কারাভ্যন্তরে প্রাণত্যাগ করেন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি যতীন দাশ (১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৯)।
  • (৬) ১৯২৯-এর ডিসেম্বরে বিপ্লবীরা বোমা ফেললেন বড়লাটের স্পেশাল ট্রেনের ওপর। এই সময়েই কলকাতার মেছুয়াবাজারে আবিষ্কৃত হল একটি বোমার কারখানা (১৮ই ডিসেম্বর, ১৯২৯)। এই সব ঘটনা জাতির প্রাণে আগুন জ্বেলে দেয়।
  • (৭) যুব সমাজ তখন যে-কোন ত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিল। গান্ধীজি উপলব্ধি করেন যে অগ্নিকুণ্ড ভারতকে যুব সম্প্রদায়ের হিংসাশ্রয়ী রাজনৈতিক কবল থেকে সরিয়ে আনতে গেলে পুনরায় একটি অহিংস আন্দোলন শুরু করা ভিন্ন গত্যন্তর নেই।
  • (ঞ) সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন
  • (১) ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ভারতের সাংবিধানিক অগ্রগতি সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য ‘শ্বেতাঙ্গ-সর্বস্ব’ সাইমন কমিশন নিয়োগ করলে ভারতীয় রাজনীতি প্রাণচঞ্চল হয়েওঠে।
  • (২) যুব সমাজ অতি সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা দেশে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনা দেখা দেয়। সাইমন কমিশনকে কেন্দ্র করে লাহোরে পুলিশের লাঠি চালনায় শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা লালা লাজপৎ রায় মারা যান। এইভাবে কংগ্রেসের সামনে এক বৃহত্তর গণ-আন্দোলন গড়েতোলার সুযোগ আসে।

(ট) নেহরু রিপোর্ট

  • (১) ভারত সচিব লর্ড বার্কেনহেড পর পর দু’বার ভারতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি ব্যঙ্গ করে বলেন যে, তাঁরা কখনই সর্বদলের গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান রচনা করতে পারবেন না। এই ব্যঙ্গের উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য মতিলাল নেহরুরসভাপতিত্বে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠিত হয়।
  • (৩) ১৯২৫-এর ১০ই নভেম্বর পুলিশ দক্ষিণেশ্বরের একটি বাড়িতে বিরাট বোমার কারখানা আবিষ্কার করে। ১৯২৬-এর মে মাসে পুলিশের স্পেশাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ভূপেন চ্যাটার্জী আলিপুর জেলের অভ্যন্তরে দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলার আসামিদের হাতে নিহত হন।
  • (৪) ভগৎ সিং-এর নেতৃত্বাধীন হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের বিপ্লবীরা লালা লাজপৎ রায়ের হত্যাকারী পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন (১৭ই ডিসেম্বর, ১৯২৮)।
  • (২) এই কমিটি ‘নেহরু কমিটি’ নামে পরিচিত। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর এই কমিটি ভারতীয় সংবিধানের একটি খসড়া প্রকাশ করে, যা নেহরু রিপোর্ট নামে পরিচিত।
  • (৩) এই রিপোর্টে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ বা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়।
  • (৪) জওহরলাল-সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন যুবগোষ্ঠী এর বিরোধিতা করে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ বা স্বাধীনতার দাবি করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে এই ব্যাপারে প্রবল বিতণ্ডা হয়।

আইন অমান্য আন্দোলনের গুরুত্ব

আইন অমান্য আন্দোলন তার ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও ভারতীয় ‘স্বরাজ’ সাধনার ইতিহাসে তার গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন –

(১) সর্বস্তরের মানুষের যোগদান

আইন অমান্য আন্দোলন ছিল একটি সর্বভারতীয় আন্দোলন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, পেশা, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিক, কৃষক, দোকানদার, মধ্যবিত্ত, পুঁজিপতি, জাতীয়তাবাদী, সাম্যবাদী— সমাজের সর্বস্তরের ও মতাদর্শের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগদান করে।

(২) ব্যাপক যোগদান

দরিদ্র, নিরক্ষর, মহিলা ও কিশোরদের যোগদান ছিল ব্যাপক। বাংলা পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যান লিখছেন—“কংগ্রেস সংগঠন এ রকম অজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকদের কাছ থেকে এত সহানুভূতি ও সমর্থন কি করে পেল তা আমার মাথায় ঢুকছে না।” এই আন্দোলনে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার দেশপ্রেমিক কারারুদ্ধ হয়। এই সংখ্যাটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের তিনগুণ বেশি।

(৩) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর প্রভাব

এই আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর প্রবল আঘাত হানে। ভারতে ব্রিটিশ পণ্যের আমদানি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়। বোম্বাইয়ে ইংরেজদের পরিচালিত ১৬টি বস্ত্রশিল্প বন্ধ হয়ে যায়।

(৪) ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের প্রসার

বিদেশী পণ্যাদি বয়কট ও স্বদেশী ব্যবহারের ফলে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের প্রসারলক্ষ্য করা যায়। খাদির প্রসার ঘটে এবং ভারতীয় কুটির শিল্প লাভবান হয়।

(৫) ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সাফল্য দান

এই আন্দোলন স্বাধীনতার প্রতি ভারতীয়দের আকাঙ্ক্ষা এবং সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারে তাদের প্রস্তুতির কথা প্রমাণিত করে। আইন অমান্য আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ১৯৪২খ্রিস্টাব্দের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে সফল করে।

(৬) নারী মুক্তি

ভারতের নারী সমাজ বিপুল সংখ্যায় এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ভারতীয় নারীমুক্তির ইতিহাসে এই আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।

(৭) কংগ্রেসের মর্যাদা বৃদ্ধি

এই আন্দোলনের ফলে জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। সরকার উপলব্ধি করে যে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ভারতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

(৮) বহির্বিশ্বে আলোড়ন

এই আন্দোলন বহির্বিশ্বে সাড়া জাগায়। প্রমাণিত হয় যে, ভারতের স্বাধীনতারসমস্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঘরোয়া সমস্যা নয়।

(৯) কংগ্রেসের শ্রেষ্ঠত্ব

এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, কংগ্রেসই ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ দল—একে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

(১০) নৈতিক চরিত্রের উন্নতি

এই আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীজি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নৈতিক চরিত্রেরউন্নতি ঘটান এবং তাঁদের নৈতিক বলে বলীয়ান করে তোলেন।

(১১) সরকারের মর্যাদা খর্ব

পরোক্ষভাবে এই আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের প্রকৃত স্বরূপ, অমানুষিকতা ও অনৈতিক চরিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে সরকারের মর্যাদা খর্ব করে।

আরো অন্যান্য অতি জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | নবম শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর

Q1. ভারত ছাড়ো আন্দোলন আর কি নামে পরিচিত?

Ans. আগস্ট আন্দোলন ও বিয়াল্লিশের আন্দোলন।

Q2. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন কে?

Ans – মহাত্মা গান্ধী।

Q3. ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয় কখন?

Ans – ৯ আগস্ট, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে।

Q1. আইন অমান্য আন্দোলনের লক্ষ্য কি ছিল?

Ans – পূর্ণ স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জন।

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।