উডের ডেসপ্যাচ কি, উডের ডেসপ্যাচ কবে প্রকাশিত হয়, উডের ডেসপ্যাচ কে ম্যাগনাকার্টা বলা হয় কেন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

উডের ডেসপ্যাচ কি

ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং নারীশিক্ষা প্রসার ও উন্নয়নের জন্য ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক গঠিত বাের্ড অব কন্ট্রোল-এর স্যার চার্লস উড একটি শিক্ষাপ্রস্তাব প্রণয়ন করেন ও তা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন; চার্লস উডের নাম অনুসারে এই শিক্ষা প্রস্তাবকে বলা হয় ‘উডের শিক্ষাপ্রস্তাব’ বা ‘উডের ডেসপ্যাচ’। উডের ডেসপ্যাচের মূল বক্তব্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং মূল লক্ষ্য ছিল ভারতে ইংরেজি ও নারী শিক্ষার উন্নয়ন। উডের ডেসপ্যাচ রচনায় সদস্য ছিলেন মাত্র ১ জন,অর্থাৎ চার্লস উড নিজেই।

উডের ডেসপ্যাচকে বলা হয় ভারতীয় শিক্ষার ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা ‘শিক্ষা অধিকার সনদ’। উডের ডেসপ্যাচ ১৮৫৪ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, লর্ড ডালহৌসির (Lord Dalhousie) কাছে উপস্থাপন করা হয়।

উডের ডেসপ্যাচ গৃহীত হয় ১৮৫৪ সালের ১৯ জুলাই। এই শিক্ষাপ্রস্তাবে চার্লস উড ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

১৮৫৪ সালে প্রণীত ও গৃহীত হওয়া উডের ডেসপ্যাচ (Wood’s despatch) ভারতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, এই বিষযে কোনো সন্দেহ নেই; কারণ পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে তথা শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থানায় যত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে সবকিছুর মূলে উডের ডেসপ্যাচের কিছু না কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রস্তাব বা শিক্ষানীতি বলে অভিহিত উডের ডেসপ্যাচের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি শিক্ষার ‘নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি’ ত্যাগ করে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। সুতরাং, এখানে উল্লেখ করা যায় যে, স্বাধীন ভারত, পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকস্তান বা পূর্ব বাংলা এবং বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে তার ভিত্তি রচিত হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই শিক্ষা সংক্রান্ত দলিল উডের ডেসপ্যাচে’। 

উডের ডেসপ্যাচ যে সকল সুপারিশ করেছিল সেসবের মধ্যে বেশ কিছু হলো-

  • পৃথক শিক্ষা বিভাগ গঠন
  • বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
  • মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
  • জনশিক্ষা ব্যবস্থা
  • গ্রান্ট-ইন-এইড প্রথার প্রবর্তন
  • শিক্ষক-প্রশিক্ষণ
  • বৃত্তিমূলক শিক্ষা
  • নারী শিক্ষা ইত্যাদি

উডের ডেসপ্যাচ উপর্যুক্ত বিষয়গুলোতে গুরুত্ব প্রদানপূর্বক শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার উপর সুপারিশ পেশ করেছিল।

উডের ডেসপ্যাচ কবে প্রকাশিত হয়

১৮৫৪ সালের ১৯ শে জানুযায়ী বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড ত‍ৎকালীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ধাঁচে সাজিয়ে তোলার জন‍্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ নামা জারি করেন যা ইতিহাসে উডের ডেসপ‍্যাচ (Wood’s Despatch) নামে পরিচিত, এই নির্দেশনামায় এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল যা আজও আমাদের দেশের শিক্ষাব‍্যবস্থায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে যেমন —

  • লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে কলকাতা,বোম্বাই,মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সুপারিশ করা হয়,,শুধু তাই নয় সেখানে আইন, দর্শন, বিজ্ঞান, এবং পেশাগত (ITI) শিক্ষাদানের ব‍্যবস্থা করতে বলা হয়।
  • শিক্ষাব‍্যবস্থার উন্নতির লক্ষে এবং সঠিক ভাবে স্কুলশিক্ষা পরিচালনার জন‍্য আলাদা কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়।
  • শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের সঠিক এবং উপযুক্ত পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেবার জন‍্য সর্বপ্রথম শিক্ষক-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান(Teachers Training College)এর কথা এই নির্দেশনামা তেও সুপারিশ করা হয়।
  • স্কুলগুলির পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন‍্য সরকারী অনুদান(Grant in Aid)এর সুপারিশ করা হয়।
  • গোটা দেশ জুড়ে বেশী করে প্রাথমিক বিদ‍্যালয় ও ইংরাজী মাধ্যম বিদ‍্যালয় চালুর সুপারিশ করা হয়।
  • নারীশিক্ষার বিস্তারে জোর দেবার কথা বলা হয়।
  • মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান(Scholarship)এর কথা বলা হয় সর্বপ্রথম এই নির্দেশনামায়।

উডের ডেসপ্যাচ বলতে কী বোঝো

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে ইংরেজরা কোনো লম্ব পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তাঁদের ভয় ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটলে ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে তা ক্ষতিকারক হবে। অবশেষে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার

চার্লস উড ভারতে শিক্ষা প্রসারের জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতি ঘোষণা করে একটি নির্দেশপত্র পাঠান। এটি উডের ডেসপ্যাচ বা নির্দেশনামা নামে পরিচিত। ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটি একটি মহাসনদ বা ম্যাগনা কার্টা।

১) ভারতবাসীর শিক্ষার দায়িত্ব ভারত সরকারকে নিতে হবে।

২)  সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাঁচটি শ্রেনীতে ভাগ করতে হবে।

৩) প্রত্যেক প্রদেশে স্বতন্ত্র শিক্ষা দপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৪) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।

৫) কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ এই তিন প্রেসিডেন্সি শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৬)  একটি পৃথক শিক্ষা দপ্তর গঠন করতে হবে।

৭)  উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ কর্তা হিসেবে “ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন” পদ সৃষ্টি করতে হবে।

৮) বেসরকারি বিদ্যালয় গুলিকে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯)  নারী শিক্ষা প্রসারের ব্যাপারে জোর দিতে হবে।

১০) মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করতে হবে।

১১) শিক্ষক -শিক্ষণ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

১২) সাধারণ শিক্ষায় মাতৃভাষার ব্যবহার করতে হবে ।

১৩) উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে হবে প্রভৃতি।

উডের নির্দেশনামার ভিত্তিতে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হতে থাকে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার জন্য প্রত্যেকটি প্রদেশে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাবিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড মেয়ো প্রাদেশিক সরকারের ওপর শিক্ষা দপ্তরের ভার দেন।

উডের ডেসপ্যাচ এর বৈশিষ্ট্য

1813 খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে ভারতীয় জনগণের শিক্ষার বিস্তারের জন্য কোম্পানির তহবিল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত সরকার শিক্ষাকে সঠিক অর্থে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে মেনে নেয়নি। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ালেও, কোনাে সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়নি। উড-এর ডেসপ্যাচেই সর্বপ্রথম একটি সুসংগঠিত সরকারি শিক্ষানীতির আভাস পাওয়া যায়।

উডের ডেসপ্যাচ সুপারিশ গুলি কি কি, উডের ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ

আগামী দিনে শিক্ষাকে কীভাবে সংগঠিত করা হবে, শিক্ষাক্ষেত্রে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কীভাবে করা হবে—সে বিষয়ে উড-এর ডেসপ্যাচে কতকগুলি সুপারিশ লিপিবদ্ধ করা হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সুপারিশ উল্লেখ করা হল—

(1) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: ডেসপ্যাচের প্রস্তাবনায় বলা হয়—

  • ভারতীয় জনগণের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞানের বিস্তার ঘটানােই হল এদেশের শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। এই পাশ্চাত্যজ্ঞান হবে ভারতের জনগণের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।
  • এই শিক্ষার অপর একটি উদ্দেশ্য হবে, ভারতের জনগণের বুদ্ধির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নৈতিক চরিত্রগঠনের সহায়ক হয়ে ওঠা।
  • এই শিক্ষা ভারতের জনগণকে শ্রম ও পুঁজি বিনিয়ােগের ফলাফল বুঝতে এবং দেশজ প্রাকৃতিক সম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে। এই শিক্ষার বিকাশ ঘটলে কোম্পানি আগামী দিনে ভারতবাসীর মধ্য থেকে দক্ষ ও বিশ্বস্ত কর্মী পাবে।
  • এই শিক্ষার আর একটি উদ্দেশ্য হবে—ভারত থেকে। কাঁচামাল সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডের শিল্পের বিকাশ ঘটানাে এবং ভারতবাসীর মানসিকতাকে এরকমভাবে গড়ে তােলা যাতে ভারতের বাজারে ইংল্যান্ডে উৎপন্ন পণ্যসামগ্রীর অফুরন্ত চাহিদা সৃষ্টি হয়।

সব মিলিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য‌ একটি নির্দিষ্ট বাজার সৃষ্টি করাকে ভারতীয় শিক্ষার একটি বিশেষ লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়েছিল৷

(2) শিক্ষার বিষয়বস্তু: উড-এর ডেসপ্যাচে প্রাচ্যশিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকার করা হলেও, বলা হয়েছে প্রাচ্য বিজ্ঞান ও দর্শন অজস্র ভুলে ভরা। তাই প্রাচ্য বিজ্ঞান ও দর্শনের পরিবর্তে পাশ্চাত্য কলা, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যই হবে ভারতবাসীর কাছে শিক্ষার বিষয়বস্তু।

(3) শিক্ষার মাধ্যম ও ভাষাশিক্ষা: উড-এর ডেসপ্যাচে শিক্ষার মাধ্যম এবং ভাষাশিক্ষা বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান নির্দেশ দান করা হয়। ভারতীয় জনগণ যাতে ইউরােপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ইংরেজি ও দেশীয় ভাষা উভয়ই ব্যবহার করতে পারে—সে প্রসঙ্গে ডেসপ্যাচে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

(4) শিক্ষা বিভাগ স্থাপন: উড-এর ডেসপ্যাচে কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি প্রদেশে একটি করে সরকারি শিক্ষা বিভাগ স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। ওই পাঁচটি প্রদেশ হলবাংলা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ। সুপারিশে আরও উল্লেখ করা হয়—ওই শিক্ষা বিভাগগুলির প্রধান 56717- Director of Public Instruction, সংক্ষেপে DPI। DPI-কে সাহায্য করার জন্য তার অধীনে একদল পরিদর্শক (Inspectors) নিযুক্ত থাকবেন। এই বিভাগ প্রত্যেক প্রদেশের শিক্ষার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রাদেশিক সরকারের নিকট বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন: উড-এর ডেসপ্যাচে দ্বিতীয় প্রস্তাব হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে স্থাপিত হবে। কলকাতা, বােম্বাই এবং মাদ্রাজে একটা করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন একজন আচার্য, একজন উপাচার্য এবং কয়েকজন সরকার মনােনীত সদস্যের দ্বারা গঠিত ‘সিনেট’।

(5) স্তরবিন্যাস শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন: উড-এর ডেসপ্যাচে স্তরবিন্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের সুপারিশও করা হয়। এই সুপারিশে বলা হয় স্তরবিন্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থার চূড়ায় থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অধীনস্থ মহাবিদ্যালয়সমূহ, মাঝে থাকবে হাইস্কুল শিক্ষা তথা মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে প্রাথমিক শিক্ষা।

(6) চুঁইয়ে পড়া নীতির সমালোচনা ও জনশিক্ষার দায়িত্বগ্রহণ: উড-এর ডেসপ্যাচে শিক্ষার চুঁইয়ে পড়া নীতির গভীর সমালােচনা করা হয় এবং সরকার যাতে অধিক পরিমাণে জনশিক্ষা প্রসারের দায়িত্ব গ্রহণ করে, সে বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও মাতৃভাষার প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষার সাহায্য গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

(7) শর্তসাপেক্ষে অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা: উড-এর ডেসপ্যাচে বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহকে উৎসাহদানের উদ্দেশ্যে শর্তসাপেক্ষে ‘grant-in-aid’ প্রথা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, অর্থ সাহায্য নিতে আগ্রহী বিদ্যালয়গুলিকে নিম্নলিখিত শর্তগুলি মেনে চলতে হবে—

  • বিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে।
  • বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটি আইনানুগভাবে নির্বাচিত হবে।
  • বিদ্যালয় পরিদর্শকের নির্দেশানুসারে বিদ্যালয়ের কাজ চালাতে হবে।
  • বিদ্যালয় ছাত্রদের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ হলেও বেতন আদায় করবে।
  • শিক্ষকদের শিক্ষাগত যােগ্যতা, শিক্ষার মান ও ফলাফল উন্নত করতে হবে।

(8) শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা: উড তাঁর ডেসপ্যাচে এদেশের শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ কালে তাদের বৃত্তিদানের সুপারিশ করেন।

(9) বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা: উড-এর ডেসপ্যাচে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র, কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের সুপারিশ করা হয়।

(10) স্ত্রীশিক্ষার প্রসার: উড-এর ডেসপ্যাচে অধিক সংখ্যায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। বালিকাদের চারিত্রিক মাধুর্য ও ব্যক্তিত্বের বিকাশের উপযােগী পৃথক পাঠক্রম প্রণয়নের কথাও বলা হয়।

(11) সংখ্যালঘুদের শিক্ষা: মুসলমান রাজশক্তিকে পরাস্ত করে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের ইংরেজ-বিদ্বেষ ছিল প্রবল। এই বিদ্বেষের কারণে মুসলমানরা ইংরেজ-প্রবর্তিত শিক্ষায় কোনাে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ফলে তারা আধুনিক শিক্ষার দিক থেকে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছিল। এই অবস্থার উন্নতি ঘটানাের জন্য উড-এর ডেসপ্যাচে মুসলমানদের জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তােলার সুপারিশ করা হয়।

(12) পাঠ্যপুস্তক রচনা: উড-এর ডেসপ্যাচে, প্রাথমিক স্তরে এবং আংশিকভাবে মাধ্যমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে পঠন পাঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতে শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানকে নির্বাচন করা হয়। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে সহজে পৌঁছােনাের জন্য উড-এর ডেসপ্যাচে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞান-এর ইংরেজিতে লেখা বইগুলিকে দেশীয় ভাষায় অনুবাদের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

উডের ডেসপ্যাচ কে ম্যাগনাকার্টা বলা হয় কেন, উডের ডেসপ্যাচ কি ম্যাগনাকার্টা বলা হয় কেন

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হলেও স্বাধীন হয়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ। ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তভূক্ত হয়ে থাকে। বাঙালীদের উপর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বৈষম্য, শোষণ-নিপীড়ন, জোড়-জুলুম, অন্যায়-অত্যাচার শেষ হয়ে গেলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালীদের উপর চরম বৈষম্য, অন্যায়-অত্যাচার শুরু করে।

তারই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদেরা এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে এবং ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা দাবি আদায়ের লক্ষে কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়।

ক্রমান্বয়ে ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন গড়ে উঠে। আর তাই ছয় দফা দাবিকে বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ বলা হয় এবং এটিকে ইংল্যান্ডের রাজা জন কতৃক স্বীকৃত ম্যাগনাকার্টার সাথে তুলনা করা হয়।

উডের ডেসপ্যাচ এর গুরুত্ব কি, উডের ডেসপ্যাচ এর গুরুত্ব

১৮৫৪ সালে প্রকাশিত উডের ডেসপ্যাচ কেন গুরুত্বপূর্ণ তা উপরে উল্লিখিত সুপারিশমালার সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে বোঝার কথা। তবে পাঠকদের বোঝা সহজতর করার জন্য এখানে বুলেট পয়েন্টে উল্লেখ করা হলো যে, কেন উডের ডেসপ্যাচ গুরুত্বপূর্ণ।

  • সর্বস্তরের মানুষকে শিক্ষা প্রদানের সুপারিশ
  • কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
  • ‘নিম্নগামী পরিস্রাবণ নীতি’ বাতিল
  • মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান
  • নিম্নস্তরের মানুষদের শিক্ষার্জনের পক্ষে আর্থিক সাহায্য
  • ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় গুরুত্বারোপ
  • নারী শিক্ষায় গুরুত্বারোপ
  • বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু
  • মুসলিমদের জন্য আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা
  • শিক্ষক প্রশিক্ষণ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ

উডের ডেসপ্যাচ এর সীমাবদ্ধতা

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আমল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ।কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের  পাঠক্রম ও গঠনরীতিতে কোন সামঞ্জস্য ছিল না।

এই পরিস্থিতিতে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে জুলাই ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে একটি বিশদ পরিকল্পনা বা নির্দেশনামা পেশ করেন । এটি উডের নির্দেশনামা (wood’s Despatch) নামে খ্যাত।

উডের ডেসপ্যাচ পাশ্চাত্য শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যে সুপারিশগুলো করেছিল তা ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক, এই কারণে একে সাফল্যের সাথে শতভাগ বাস্তবায়ন করা যায়নি।

চার্লস উডের সুপারিশের ফলাফল

চার্লস উডের  নির্দেশনামার ফলে –

(১) লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৫ সালে বাংলা,বোম্বাই ও পাঞ্জাবে শিক্ষাদফতার প্রতিষ্ঠা করেন।

(২) ১৮৫৭ সালে কলকাতা,বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ।

আরো অন্যান্য সরকারি স্কিম সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | উডের ডেসপ্যাচ

Q1. উডের ডেসপ্যাচ কত সালে হয়

Ans – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে কোম্পানির বাের্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি উডের নির্দেশ নামা এক মাইলস্টোনরূপে স্বীকৃত হয়ে রয়েছে । তিনি বাের্ড অব কন্ট্রোলের সদস্যদের নিয়ে শিক্ষাবিষয়ক একটি কমিটি গঠন করে সরকারি শিক্ষানীতি সম্পর্কে যে সুপারিশ পেশ করেন তা উডের প্রতিবেদন বা উডের ডেসপ্যাচ ( ১৮৫৪ , ১৯ জুলাই ) নামে পরিচিত । উড ভারতে প্রাথমিক , মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ।

Q2. উডের ডেসপ্যাচ এর প্রধান সুপারিশ

Ans – উডের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো নিচে আলোচনা করা হল –

(১)শিক্ষার প্রসারের জন্যে স্বতন্ত্র শিক্ষাবিভাগ গড়ে তোলার উপর জোর দেন তিনি। 
(২)শিক্ষাস্তরকে পাঁচটি স্তরে বিভক্ত করেন।যথা-প্রাথমিক,মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিক ,বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগ 
৩) প্রতিটি প্রেসিডেন্সিতে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ।
(৪)দেশীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা ।
(৫)বিদ্যালয় পরিচালন কমিটি গঠন 
(৬)নারী শিক্ষার প্রসার 
(৭)মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দান করা ।
(৮)টিচার্স ট্রেনিং কলেজ স্থাপন করা ।
(৯)পাঠ্যক্রমের সাদৃশ্য ও বিন্যাস ঘটানো ।

Q3. উডের ডেসপ্যাচ কে মহাসনদ বলা হয় কেন

Ans – ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এইজন্য উডের নির্দেশনামাকে ভারতীয় শিক্ষার মহাসনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলা হয়।

Q4. উডের ডেসপ্যাচ কার আমলে প্রকাশিত হয়

Ans – উডের ডেসপ্যাচ লর্ড ডালহৌসির আমলে প্রকাশিত হয়

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।