গণতন্ত্র কাকে বলে, গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভ কি কি, গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

প্রশ্নপত্র

গণতন্ত্র কাকে বলে

গনতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে নীতিনির্ধারণে বা প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সকল সদস্য বা নাগরিকের সমান অধিকার থাকে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সদস্য বা নাগরিকদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকে। নাগরিক বা সদস্যদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ আইন প্রস্তাবনা, তৈরী এবং প্রণয়নের কাজ করে থাকেন।

গণতন্ত্র শব্দটি যদিও সাধারণভাবে কোন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক পরিমন্ডলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবুও সংস্থা কিংবা নানা ধরনের সংগঠনের ক্ষেত্রেও গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রযোজ্য হতে পারে।

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও

গ্রিকরা সর্বপ্রথম গণতন্ত্র শব্দটিকে ব্যবহার করেন। গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Democracy শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে – ডিমোস , যার অর্থ জনগণ এবং ক্রেটাস , যার অর্থ শাসন। অর্থাৎ গণতন্ত্র কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল – জনগণের শাসন। 

গণতন্ত্র সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন – গণতন্ত্রে জনগণই হল চূড়ান্ত ক্ষমতার উৎসস্থল। 

  • লর্ড ব্রাইস বলেছেন – গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা সেদেশের সকলের হাতে অর্পিত থাকলেও তা প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। 
  • ডাইসি বলেছেন – যেধরনের শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হাতে শাসনক্ষমতা অর্পিত থাকে – তাকে বলে গণতন্ত্র। 
  • মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন – জনগণের জন্য , জনগণ কর্তৃক পরিচালিত জনগণের শাসন হল গণতন্ত্র। 
  • সুইজি বলেছেন – গণতন্ত্রে জনগণই হলেন শাসনব্যবস্থার উৎসস্থল। 

তবে গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন – স্যুমপিটার , রবার্ট ডাল , জি সি ফিল্ড – প্রমুখ। স্যুমপিটারের মতে , গণতন্ত্র হল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করা। সি জি ফিল্ড বলেছেন , গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহনের ক্ষমতাকে জনগণ সরাসরি প্রভাবিত করে থাকে।

সার্বিকভাবে বলা যায় , গণতন্ত্র হল এমন এক ধরণের প্রতিষ্ঠান যেখানে শাসন ক্ষমতার উৎস হল জনগণ , প্রয়োজনে জনগণ শাসকদের নিয়ন্ত্রণ ও পদচ্যুত করতে পারেন। তবে সমাজতন্ত্রবাদীরা অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে অভিমত পোষণ করেন। 

গণতন্ত্র বলতে কি বুঝায়

গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে জনগণের শাসন। অতীত ও মধ্যযুগে গণতন্ত্র মূলত এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক যুগে গণতন্ত্র বলতে আমরা কেবল এক ধরনের সরকারকেই বুঝিনা, সাথে সাথে এক ধরনের সমাজ ব্যবস্থাকেও বুঝি। এ ধরনের সমাজব্যবস্থা যেখানে বিরাজমান নেই, সেখানে শাসনপ্রথা গণতন্ত্র নামে পরিচিতি হলেও তা সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক নয়। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্র বলতে আমরা এক প্রকার শাসন ব্যবস্থাকে বুঝি।

প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রীক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস (Herodotus) গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলেছেন, “গণতন্ত্র এক প্রকার শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসন ক্ষমতা কোন শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের উপর ন্যস্ত থাকে না, বরং সমাজের সদস্যগণের উপর ন্যস্ত হয় ব্যাপকভাবে।”

এর প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই আধুনিককালের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ লর্ড ব্রাইসের সংজ্ঞায়। গণতন্ত্র সম্পর্কে লর্ড ব্রাইস বলেন, “যে শাসন প্রথায় জনসমষ্টির অন্তত তিন-চতুর্থাংশ নাগরিকের অধিকাংশের মতে  শাসনকার্য পরিচালিত হয়, তাই গণতন্ত্র।

এক্ষেত্রে এটাও উল্লেখযোগ্য যে নাগরিকদের ভোটের শক্তি যেন তাদের শারীরিক বলের সমান হয়” (A government in which the will of the majority of the qualified citizens rules …. Say, at least three-fourths so that the physical force of the citizens coincides with their voting power”).

লর্ড ব্রাইস এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ঐ শাসনব্যবস্থাই গণতান্ত্রিক, যা (ক) জনসাধারণের ইচ্ছা, (খ) তাদের মঙ্গলামঙ্গল ও (গ) হিতকর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং (ঘ) যেখানে সাম্য ও স্বাধীনতা প্রাধান্য পায়। বিয়াট্রীস ওয়েব (Beatrice Webb) ও সিডনি ওয়েব (Sidney Webb) আর এক ধাপ অগ্রসর হয়ে বলেছেন, “কোন নির্দিষ্ট এলাকায় সকল প্রাপ্তবয়স্ক অধিবাসীদের সংঘ যখন রাজনৈতিক আত্মশাসনের ক্ষমতা ও অধিকার ভোগ করে তখন তাকে রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলা হয়।”

স্যার ক্রিপস বলেন, ”গণতন্ত্র বলতে আমরা সেই শাসনব্যবস্থাকে বুঝি, যেখানে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সকল বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং সকলের মধ্যে নিজ নিজ মত প্রকাশ করতে পারে।”

ম্যাকইভারের মতে, “গণতান্ত্রিক শাসনে সরকার জনগণের এজেন্ট মাত্র এবং সেই হিসেবে তারা সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে।”

তবে গণতন্ত্র সম্পর্কে সি এফ স্ট্রং (C F Strong) এর সংজ্ঞা অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বলেন, “শাসিতগণের সক্রিয় সম্মতির উপর যে সরকার প্রতিষ্ঠিত তাকে গণতন্ত্র বলা যায়” (“Democracy implies that government which shall rest on active consent of the governed”) ।

কিন্তু, গণতন্ত্র সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞাই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়, যদিও তা অধিকতর অস্পষ্ট। তাঁর মতে, “গণতন্ত্র হল, জনসাধারণের দ্বারা, জনসাধারণের কল্যাণের জন্যে পরিচালিত ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা” (“Government of the people, by the people and for the people”) । প্রেসিডেন্ট লিংকন আর ও বলেন, “জনসাধারণের সম্মতি ছাড়া তাদেরকে শাসন করবার অধিকার কারো নেই”। (“No man has a right to govern without other man’s constant”) ।

অনেকে আবার গণতন্ত্রকে একাধারে শাসনব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা হিসেবেও বর্ণনা করেন। গণতন্ত্র বলতে অনেকে আবার অর্থনৈতিক সাম্যের কথাও বলেন। শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র বলতে এটাই বুঝায় যে রাষ্ট্রের সকল শ্রেণীর মানুষ সমভাবে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে, আইন পরিষদে সকল শ্রেণীর মতামত প্রতিফলিত হয় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় নিয়মিত নির্বাচন প্রতিযোগিতায়, রাজনৈতিক কার্যাবলীতে সকলের অংশগ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তিতে গড়ে উঠা শাসনব্যবস্থাই রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলা যায়।

অন্যদিকে সমাজব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র বলতে আমরা সেরূপ সামাজিক পরিবেশকে বুঝি যেখানে তীব্র অসাম্য অনুপস্থিত এবং সমতার ভিত্তিতে সকলে জনকল্যাণকর কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করে এবং সকলে সমাজের অপরিহার্য অংশ হিসেবে সুখ-সুবিধার অংশীদার হয়।

আবার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সকলকে সমান সুযোগ দান করে, কাজ করবার অধিকার হতে কেউ বঞ্চিত নয় এবং সর্বোপরি সকলের সর্বনিম্ন প্রয়োজনীয় বস্তুর অভাব বোধ না হয়। অনেকের মতে, এই তিন ব্যবস্থা সু-সমন্বিত হলেই কেবল অকৃত্রিম ও অনাবিল গণতন্ত্র সম্ভব।

গণতন্ত্রের সুবিধা | গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি

১. জনগণের সার্বভৌমত্ব :- 

গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই হলেন সকল ক্ষমতার মূল উৎস। সরকার গঠিত হয় জনগণের সম্মতিক্রমে এবং জনগণের ইচ্ছা – অনিচ্ছা , আশা – আকাঙ্খা দ্বারা প্রভাবিত হয় সরকার পরিচালিত হয়। 

২. স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ :- 

একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো যায়। মানুষের জীবন , সম্পত্তি ও অধিকার – ইত্যাদির স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটে গণতন্ত্রের মাধ্যমেই। 

৩. আইনের শাসন :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একমাত্র বিধিবদ্ধ পদ্ধতি ছাড়া জনগণের স্বাভাবিক জীবনে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে না। গণতন্ত্রে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক অধিকারগুলি চরিতার্থ করে আইনের মাধ্যমেই। 

৪. সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যক্তিকল্যাণ :- 

গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হল সর্বাধিক মাত্রায় ব্যক্তি কল্যাণ। একমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যেই একজন ব্যক্তি তার অর্থর্নীহিত সত্তার বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ লাভ করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের সময়েও সর্বাধিক ব্যক্তিকল্যাণের বিষয়টি খেয়াল রাখে। 

৫. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার জন্য গণতন্ত্রে বিশেষ সাংবিধানিক বিধি – ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। ফলে আইন ও শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচার বিভাগের উপর কর্তৃত্ব আরোপের সম্ভাবনা গণতন্ত্রে খুব কম। 

৬. তিনটি মূলনীতি : সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতা :- 

গণতন্ত্রে ফরাসি বিপ্লব উদ্ভুত তিনটি প্রধান আদর্শ – সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতার অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এখানে আইন সকলের প্রতি সমানভাবে প্রযুক্ত হয় এবং আইন কর্তৃক সকলেই সমভাবে সংরক্ষিত হন। একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই ব্যক্তিস্বাধীনতা সর্বাধিকরূপে চরিতার্থ করা সম্ভব। 

৭. ব্যক্তি স্বাধীনতার চরম প্রকাশ :- 

নাগরিকদের বিভিন্ন প্রকার স্বাধীনতা – যেমন পৌর ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা – ইত্যাদি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ হারে প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্র নাগরিকদের এই সকল স্বাধীনতা রক্ষা করতে নাগরিকদের নিকট বদ্ধপরিকর থাকে। 

৮. ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ :- 

একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের সর্বোচ্চ সুযোগ থাকায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সর্বোচ্চ হারে প্রকাশের সুযোগ পায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের আদর্শ ও সহায়ক পরিবেশ রচনা করে ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষতা বিধান করে। 

৯. রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ :- 

যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতার উৎস হলেন জনগণ এবং জনগণের সম্মতিক্রমে ও জনগণের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হয় ; তাই গণতন্ত্রে মানুষের রাজনৈতিক ক্রিয়া – কলাপ অধিক পরিমাণে সংগঠিত হয় – ফলে মানুষের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। 

১০. স্বৈরাচারের সম্ভাবনা হ্রাস :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অধিক সংখ্যক জনগণের সম্মতিক্রমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের ইচ্ছা – অনিচ্ছাকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় – ফলে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুব কম। কেননা , গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। 

১১. মানুষের ইচ্ছা – অনিচ্ছার যথার্থ প্রতিফলন :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের সম্মতির উপর ভিত্তি করে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ; ফলে সরকার জনগণের ইচ্ছা – অনিচ্ছা ও আশা – আকাঙ্খার প্রতি সংবেদনশীল থাকতে বাধ্য থাকেন। ফলে মানুষের রাষ্ট্রীয় নীতিতে জনগণের ইচ্ছা – অনিচ্ছার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে। 

১২. বিপ্লবের সম্ভাবনা হ্রাস :- 

জনগণের সম্মতির উপর ভিত্তি করে সরকার নির্বাচিত হওয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণ – বিপ্লবের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। 

১৩. দায়বদ্ধতা :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকে। শাসন বিভাগ আইন বিভাগের প্রতি দায়বদ্ধ  থাকে।               

১৪. জনকল্যাণকর রাষ্ট্র :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হল জনকল্যাণ। এখানে রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের প্রতি শাসন আরোপিত হওয়ার পরিবর্তে জনগণের কল্যাণের জন্য নীতি আরোপিত হয়। 

গণতন্ত্রের অসুবিধা | গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তি

১. অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার পরিচালনার সম্ভাবনা :- 

গণতন্ত্রে সকলের অধিকার সমান ; তাই অযোগ্য ব্যক্তিরাও গণতন্ত্রে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ ও পরিচালনার সুযোগ পান – যা কখনোই উৎকৃষ্ট শাসন পরিচালনা করতে পারেনা। 

২. সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি অধিক গুরুত্ব :- 

গণতন্ত্রে সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে নীতি প্রণয়ন – সবকিছুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি প্রযুক্ত হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই উৎকর্ষতার পরিবর্তে সাধারণের সম্মতির উপর আস্থা প্রকাশের ফলে – শাসন কার্য পরিচালনা ও নীতি প্রণয়ন তার মূল লক্ষ্য চরিতার্থ করতে পারেনা। 

৩. সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষা :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে প্রয়াসী হয়ে থাকে ; ফলে গণতন্ত্রে সকলের স্বার্থ সুরক্ষিত হওয়া সম্ভব নয়। এজাতীয় ব্যবস্থায় কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রীয় নীতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। 

৪. আমলাতান্ত্রিকতা :- 

অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিরা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে শাসন কার্যে অংশগ্রহণ করলে তারা আমলাদের উপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে শাসন পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণের সকল অংশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। 

৫. জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয় :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো নীতি নির্ধারণ ও পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সকলের সম্মতি ও বিস্তর আলাপ – আলোচনা – ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জরুরি অবস্থার সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। 

৬. ব্যয়বহুল :- 

অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলির তুলনায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিভিন্ন নির্বাচন , উপনির্বাচন , যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রয়োজনে বিভিন্ন সরকার – ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। আবার এত ব্যয়ের পরেও জনগণের আশা – আকাঙ্খা চরিতার্থ না হলে – তা হয় অপচয়ের নামান্তর। 

৭. দলীয় স্বার্থ :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দল জনগণের সন্মতিক্রমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু শাসক দল ও বিরোধী দলের মধ্যে স্বার্থের যে দ্বন্দ্ব তৈরী হয় তার ফলে জনগণের আশা – আকাঙ্খার তুলনায় দলীয় স্বার্থ প্রধান হয়ে ওঠে। 

৮. পুঁজিবাদের বিকাশ :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি প্রধান প্রক্রিয়া। এই নির্বাচনের খরচের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পুঁজিপতিদের আশ্রয়প্রার্থী হয় এবং নির্বাচনে জয়লাভের পর শাসক দল পুঁজিপতিদের স্বার্থেই নীতি নির্ধারণ করে ; ফলে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। 

৯. রক্ষনশীলতার সম্ভাবনা:- 

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যদি মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয় , তাহলে তা রক্ষণশীল হতে বাধ্য। কেননা অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা কখনোই প্রগতিশীল উদ্ভাবন সম্ভব নয় ; ফলে শাসন ব্যবস্থা রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। 

১০. সরকারের স্থায়িত্ব ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা :- 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী , জাত ও ধর্ম , বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান – ইত্যাদির পারস্পরিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়। সরকার তাদের সকলের স্বার্থে কাজ না করতে পারলে সরকারের স্থায়িত্ব ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরী হয়।      

গণতন্ত্রের জনক কে

গণতন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ হল “জনগণের দ্বারা শাসন”, গ্রীক ভাষায়, ডেমোকে “মানুষ” এবং ক্র্যাটোস “শাসন” দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়।

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বীজ অনেক পুরানো, এবং প্রাচীন ভারতীয় মহাজনপদ, সংঘ, গন এবং পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ইরোকুয়েস কনফেডারেসি এবং রোমান প্রজাতন্ত্রের মতো নির্দিষ্ট ব্যান্ড এবং উপজাতিতে পাওয়া যায়।

ক্লেসথেনেসকে গণতন্ত্রের জনক ধরা হয়। আধুনিক গণতন্ত্রের জনক আব্রাহাম লিংকন।

গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি, গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য

গণতন্ত্রের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোন শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক কিনা তা এসব বৈশিষ্ট্যের মানদন্ডে বিচার করে সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি।

  • প্রথমত, লক্ষ্য করতে হবে উক্ত শাসনব্যবস্থায় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয় কিনা;
  • দ্বিতীয়ত, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারকে পরিবর্তন করা যায় কিনা;
  • তৃতীয়ত, উক্ত ব্যবস্থায় দল গঠন, মত প্রকাশ ও সমালোচনার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে কিনা;
  • চতুর্থত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের স্বার্থরক্ষার সুবন্দোবস্ত রয়েছে কিনা;
  • পঞ্চমত,উক্ত ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারসমূহ আইনগতভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে কিনা; এবং
  • শেষত, জনসাধারণ এ আশ্বাস পেয়েছে কিনা যে, সুষ্ঠু বিচার ছাড়া তাদের অহেতুক বন্দীদশা ভোগ করতে হবে না, অথবা অন্য কোন শাস্তি ভোগ করতে হবে না। উল্লেখিত ব্যবস্থাসমূহের উপস্থিতি যে কোন ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করতে সমর্থ।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সলটু বলেন, গণতন্ত্রের মধ্যে চার সত্য অনুধাবনযোগ্য।

  • প্রথমত, গণতন্ত্রে প্রত্যেকের স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্মগত অধিকার স্বীকার করা হয়;
  • দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের রাষ্ট্রকে কোন অভ্রান্ত সত্যের প্রতীক বলে গ্রহণ করা হয় না;
  • তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অধিকারে ক্ষেত্রে ও আইনের চোখে সবাই সমান;
  • চতুর্থত,গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সকলের মতামতের দ্বারা অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এ চারটি উপাদানের সুসমন্বয়ে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা গণতান্ত্রিক।

সুতরাং গণতন্ত্রে মৌলিক কথা হচ্ছে- শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে শাসিতদের সম্মতি লাভ।

গণতন্ত্র কত প্রকার ও কী কী

গণতন্ত্রকে নিম্নোক্ত দু’ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। যথা-

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার বা শাসনব্যবস্থা গঠন করা হয় তা হচ্ছে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে বোঝায় এমন এক সরকারকে যেখানে দেশের সকল নাগরিক সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণপূর্বক শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।

বর্তমানে রাষ্ট্রের পরিধি ও জনসংখ্যার আকৃতি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বেশ জটিল ও কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই বর্তমানকালে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পৃথিবীর খুব একটা বেশি দেশে দেখা যায় না। তবে সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি প্রদেশে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে।

পরোক্ষ গণতন্ত্র

যে গণতন্ত্রে পরোক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সরকার নির্বাচন করে তাকে পরোক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা হয়। অর্থাৎ পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে বোঝায় সেই ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিগণ শাসনকার্য পরিচালনা করে। প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয় বিধায় এর অপর নাম প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র।

এ জাতীয় শাসনব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন না করে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিনিধি নির্বাচন করে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। এ জন্যেই একে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি রাষ্ট্রে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত আছে।

পরোক্ষ গণতন্ত্র কাকে বলে

পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করার পদ্ধতিকেই বোবায়। এ ধরনের গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়।

পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝো

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে জনগণ শাসন কাজে অংশগ্রহণ করে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র আবার বিশুদ্ধ গণতন্ত্র নামেও পরিচিত। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসন কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। নাগরিকগণ কোন নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ কোন স্থানে সমবেত হয়ে আইন প্রণয়ন, রাজস্ব ও ব্যয় নির্ধারণ, সরকারি কর্মচারী নিয়োগ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতো। মাঝে মাঝে তারা বিচার ব্যবস্থাও সম্পাদন করতো।

মনীষী বার্নস প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেন, “Direct democracy is a democratic form of government…, is one in which the community as a whole, directly or immediately without agents on representatives perform the function of sovereignty.”

আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের বিশালায়তন, বিপুল জনসংখ্যা ও জটিল প্রকৃতির নানাবিধ সমস্যার কারণে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ গণতন্ত্রের পার্থক্য

নিম্নে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করা হলাে-

১. যে সরকার ব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরি নিজেরাই দেশের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে শাসনকার্য পরিচালনা করে তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলে। অপরদিকে, যে সরকার ব্যবস্থায় জনগণ তাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরােক্ষভাবে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে তাকে পরােক্ষ গণতন্ত্র বলে।

২. আধুনিক কালে কোন রাষ্ট্রেই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত নেই। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই পরােক্ষ গণতন্ত্র চালু রয়েছে।

৩. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র শুধুমাত্র ক্ষুদ্রায়তন ও সংখ্যালঘু রাষ্ট্রেই সম্ভব। অপরদিকে বৃহদায়তন ও জনবহুল রাষ্ট্রে পরােক্ষ গণতন্ত্র বিশেষ উপযােগী এবং কাম্য।

৪. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সরাসরি জনগণের মতামত যাচাই করার সুযােগ না থাকায় সঠিকভাবে জনমত প্রতিফলিত হয় না। অন্যদিকে, পরােক্ষ গণতন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের কর্তব্য বা কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে। অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় সরকারের আইন ও শাসন বিভাগ সবসময় জনমতের পক্ষে কাজ করে থাকে।

৫. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সকল নাগরিকই সরাসরি রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। তাই এ শাসনব্যবস্থাকে অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্র বলা হয়। অপরদিকে, পরােক্ষ গণতন্ত্রে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসন বা সরকার পরিচালিত হয় বলে তা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়।

গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভ কি কি

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মূলত তিনটি স্তম্ভ বা ভিত্তির উপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। এই মূল ভিত্তিগুলো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, ক্ষমতার সুষম বন্টন নিশ্চিত করার মাধ্যমে শাসনকার্যকে পরিচালনা করতে সার্বিক সহায়তা করে।

১. আইন বিভাগ

জনগনের জন্য সংবিধান মোতাবেক প্রয়োজনীয় আইন প্রনয়ন করাই এই বিভাগের প্রধান কাজ। নাগরিকদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে জনপ্রতিনিধিগণ নির্দিষ্ট মেয়াদে আইন প্রণয়নের কাজের দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত হন, আইন্সভায় স্থানপ্রাপ্ত হন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ সংবিধানের মূল কাঠামোর উপর নির্ভর করেই আইন প্রণয়ন করে থাকেন।

২. শাসন বিভাগ

প্রচলিত আইন মোতাবেক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থাকে নির্বিঘ্ন রাখাই এই বিভাগের প্রধান কর্তব্য। নাগরিকদের ভোটের সাহায্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ মূলত শাসন বিভাগের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকেন। রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রচলিত আইন অনুসারে প্রশাসনিক কার্যক্ররম পরিচালনা করে এই বিভাগ। এই বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাগণ সরকারের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে থাকেন।

৩. বিচার বিভাগ

বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে মূলত এই বিভাগ গঠিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত এবং কেন্দ্রীয় শীর্ষ আদালত নিয়ে গঠিত হয় বিচার বিভাগ। এই বিভাগের প্রধান কাজ হল রাষ্ট্রের আইন মোতাবেক বিভিন্ন বিষয়ের বিচার কার্য সম্পন্ন করা। আইনসভার প্রস্তাবনা বা সিদ্ধান্ত সংবিধান সম্মত কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা বিচারিক ব্যবস্থা গ্রহনের এখতিয়ার আছে এই বিভাগের। 

এই তিনটি মূল বিভাগের কার্যক্রম স্বচ্ছ এবং ক্ষমতার সুষম বন্টন থাকলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করা এবং ভালোভাবে জনকল্যাণমূলক উপায়ে একটি রাষ্ট্রকে পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে থাকে।

৪. গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ

সংবাদ মাধ্যম একটি দেশের সার্বিক ও সকল পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করে সে বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে পারে বলে সংবাদ মাধ্যমকে একটি রাষ্ট্রের আয়না বলা হয় এবং বর্তমানে একে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়।

কেননা একটি দেশের শাসন ব্যবস্থা, শাসনকার্যের দায়িত্বে থাকা জনপ্রতিনিধিগণ, তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার ক্ষমতা রয়েছে সংবাদমাধ্যমের। এজন্য রাষ্ট্রের সুশাসন এবং সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা নিশ্চিত করার  জন্য অন্য তিনটি মূল বিভাগের পাশাপাশি, সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ এবং জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম অতি জরুরি।

আরো পড়তে: কোড নেপোলিয়ন কি, কোড নেপোলিয়ন বলতে কী বোঝো, কোড নেপোলিয়ন টিকা

গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা কর

সাধারণভাবে গণতন্ত্র বলতে এক বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সরকারের বিভিন্ন রূপ আলোচনা প্রসঙ্গেই গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা’ হল গণতন্ত্রের সংকীর্ণ অর্থ। ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র শাসনব্যবস্থার ধারণার নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে এক মহৎ আদর্শে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান কালে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির দ্বারা এক বিশেষ সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা এমনকি এক বিশেষ অর্থ-ব্যবস্থাকেও বোঝান হয়। অধ্যাপক গিডিংস বলেছেন: “A Democracy may either be a form of government, a form of state; a form of society or a combination of all the three.” তবে গণতন্ত্রের অর্থ যা হোক, সাম্য হল এর মূল ভিত্তি। সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য, রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য বর্তমান থাকলে যথাক্রমে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয়।

গণতান্ত্রিক সমাজ

সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে গণতান্ত্রিক সমাজের (Democratic Society) সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সাম্যের ভিত্তিতে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত তাকে গণতান্ত্রিক সমাজ বলা হয়। এই সমাজব্যবস্থায় সকল ব্যক্তিই হল সমমর্যাদাসম্পন্ন। সুযোগ-সুবিধা ভোগের ব্যাপারেও সমানাধিকার বর্তমান থাকে। এইরূপ সমাজে কোন রকম বৈষম্যমূলক আচরণকে স্বীকার করা হয় না। জন্মগত ও ধনগত বৈষম্যকে এখানে সমর্থন করা হয় না। বলপ্রয়োগের কোন সুযোগ থাকে না।

সমাজজীবনের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে সকলের প্রচেষ্টাকে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়। বার্নস (C. Delisle Burns ) – এর মতে, ‘আদর্শগত বিচারে গণতন্ত্র হল এমন এক সমাজব্যবস্থা যেখানে সকল ব্যক্তি একই রকম না হলেও সকলেই সমান। অর্থাৎ প্রত্যেকেই সমাজের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অঙ্গ’ (“Democracy as an ideal, is a society not of similar persons but of equals, in the sense that each is an integral and irreplaceable part of the whole.”)।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (Democratic State) বলতে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বোঝায় যা সাম্যনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রনৈতিক সাম্য বর্তমান থাকে। জাতি-ধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রত্যেকে সমান রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করে। এর ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনসাধারণের হাতেই চূড়ান্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ন্যস্ত থাকে। জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার চূড়ান্ত অধিকারী বলে গণ্য হয়। মিল (G. S. Mill) ‘রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতায় সকলের প্রবেশাধিকার হল গণতন্ত্র’ (“Admission of all to a share in sovereign power of the state.”)।

হারশ-ও অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। তিনি বলেছেন: “…a democratic state means that the commu nity as a whole possesses sovereign authority and maintain control over affairs.” ফরাসি দার্শনিক রুশো এই সার্বভৌম সাধারণের ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রকে গণতন্ত্র হিসাবে গণ্য করেছেন। অতএব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই চূড়ান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সর্বময় অধিকারী। সেইজন্য এক্ষেত্রে জনগণের শাসন (rule of the people) প্রতিষ্ঠিত থাকে। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও কার দ্বারা শাসনকার্য পরিচালিত হবে এ বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার বা শাসনব্যবস্থা যে কোন ধরনের হতে পারে। হারশ বলেছেন: “…democracy as a form of state is consistent with any type of Government.” এই কারণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজতান্ত্রিক বা অভিজাততান্ত্রিক শাসনের সন্ধান পাওয়া যায়।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা

গণতান্ত্রিক সরকার বা শাসনব্যবস্থা (Democratic Government) হল গণতন্ত্রের সংকীর্ণ অর্থ। এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পশ্চিমী গণতন্ত্রের প্রবক্তারা গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। ভূতপূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রপতি লিঙ্কন (Abraham Lincon) গণতান্ত্রিক সরকারের সুপ্রচলিত সংজ্ঞা দিয়েছেন। গেটেসবার্গ বক্তৃতায় ১৮৬৩ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এই রূপরেখা নির্দেশ করেছেন। লিঙ্কনের মতানুসারে গণতন্ত্র হল, ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য শাসন’ (“… Govern ment of the people, by the people, for the people…”)। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতার উৎস হল জনসাধারণ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে বোঝায় জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে।

তবে জনগণের দ্বারা সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাই হল গণতান্ত্রিক সরকারের প্রকৃত বা আদি রূপ। প্রাচীনকালে গ্রীস দেশের ক্ষুদ্রাকৃতির নগর-রাষ্ট্রগুলিতে এ ধরনের প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বর্তমান ছিল। বর্তমানকালে অধিকাংশ রাষ্ট্রের আয়তন ও লোকসংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিনিধিমূলক পরোক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ হোক, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবেই এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সরকার

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে পার্থক্য আছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সর্বময় কর্তৃত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকলেও শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত নাও থাকতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে কোন রাজা বা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মুষ্টিমেয় প্রতিনিধিগণ দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন। দৃষ্টান্ত হিসাবে ইংল্যান্ডের কথা বলা যায়। ইংল্যান্ডে জনগণই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং ইংল্যান্ড হল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; কিন্তু শাসনব্যবস্থা রাজতান্ত্রিক। কারণ শাসনব্যবস্থার শীর্ষে অধিষ্ঠিত থাকেন একজন রাজা বা রানী। অথচ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের দ্বারাই শাসনকার্য পরিচালিত হয়। তবে বর্তমান বৃহদায়তন এবং জনবহুল রাষ্ট্রে জনগণের প্রত্যক্ষ শাসনের পরিবর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মত কেবল ‘জনগণের শাসন’ (rule of the people) নয়, গণতান্ত্রিক সরকারের ‘জনগণের দ্বারা শাসন’ (rule by the people) প্রতিষ্ঠিত হয়।

অর্থনৈতিক গণতন্ত্র

সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। সমাজতন্ত্রবাদীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেন। সমাজ থেকে যাবতীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের বিলোপ সাধন করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আদর্শের সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। গণতান্ত্রিক আদর্শকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বা কাঠামোতে সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে যে সকল বিষয়ের কথা বলা হয় সেগুলি হল : উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সামাজিক মালিকানা, সর্বসাধারণের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, মুনাফা অর্জনের পরিবর্তে জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের জন্য উৎপাদন পরিচালনা, সকল রকম শোষণের অবসান, শিল্প পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ প্রভৃতি। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে, ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন।

গণতান্ত্রিক জীবনাদর্শ

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকের কাছে গণতন্ত্র কেবলমাত্র একটি সামাজিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক আদর্শ বা রাজনৈতিক তত্ত্ব নয়; এ হল একটি জীবনধারা বা জীবন-যাপন পদ্ধতি (way of life)। গণতান্ত্রিক জীবনধারা বলতে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণকে বোঝায়। গণতান্ত্রিক জীবন-যাপনের ভিত্তি হিসাবে গণতান্ত্রিক আদর্শের উপর আস্থা, পারস্পরিক মত বিনিময় ও আলাপ আলোচনার উপর নির্ভরশীলতা, যে-কোন রকম বৈষম্য ও অন্যায়ের প্রতিবাদ, অপরের প্রতি সম্মানজনক আচরণ প্রভৃতির কথা বলা হয়। বলা হয় যে জীবন-যাপনের এই পদ্ধতি সকলে অনুসরণ করলে প্রত্যেকের স্বাভাবিক ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব হবে। ম্যাক্সি বলেছেন : “It is a search for way of life in which the voluntary free intelligence and activity of man can be harmonised and co-ordinated with the least possible coercion.” গণতান্ত্রিক জীবনধারায় পারস্পরিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, বলপ্রয়োগকে একেবারে অস্বীকার করা হয়।

সংসদীয় গণতন্ত্রের জনক কে, আধুনিক গণতন্ত্রের জনক কে

সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার সর্বময় অধিকারী জনগণ। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা মিলে সরকার গঠন করে। এই প্রকারের শাসন ব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় সরকার ব্যবস্থা। এই অবস্থায় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তি। এটি একটি রাজনৈতিক দলের শাসন ব্যবস্থাও বলা যেতে পারে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নগণ্য হয়ে থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্র আসলে একপ্রকার রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায়ী নাম হয়ে থাকে।

সংসদীয় গণতন্ত্রের জনক হলেন জন লক। জন লক এই রাষ্ট্র বিজ্ঞান টি এই সংসদীয় গণতন্ত্র বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে গিয়েছেন এবং পরবর্তীতে তিনি সফলতা পেয়েছেন তাই তাকে সংসদীয় গণতন্ত্রের জনক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। আলোকিত যুগের অন্যতম চিন্তাবিদ এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার ছিলেন তিনি।

গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য

গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র বর্তমানে প্রচলিত বিশ্বের দুটি বিপরীতধর্মী শাসনব্যবস্থা। যার প্রথমটি জনগণকে প্রাধান্য দেয় এবং অন্যটি জনগণকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। ফলে শাসন প্রণালি, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, সংগঠন ও বৈশিষ্ট্যভেদে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –

প্রকৃতিগণতন্ত্রএকনায়কতন্ত্র
ক্ষমতার উৎসগণতন্ত্র হল মূলত জনগণের শাসন। গণতন্ত্রে ক্ষমতার উৎস হল জনগণ। কিন্তুএকনায়কতন্ত্র হলাে এক ব্যক্তি বা একদলের শাসন।যেখানে রাষ্ট্রনায়কই হলেন সর্বেসর্বা অর্থাৎ সমস্ত ক্ষমতার উৎস ।
ব্যক্তিস্বাধীনতাগণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।একনায়কতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরােধী।
রাজনৈতিক দলগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বহু রাজনৈতিক দল বিদ্যমান থাকে।একনায়কতন্ত্রে একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বজায় থাকে ।
প্রচার মাধ্যমগণতন্ত্রে প্রচার মাধ্যমগুলাে স্বাধীন ভাবে তাদের প্রচার কার্য সম্পাদন করতে পারে ।একনায়কতন্ত্রে প্রচার মাধ্যমগুলাের উপর কড়া বিধিনিষিধ আরােপ করা হয়।
আইনসভাগণতন্ত্রে আইনসভা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ।একনায়কতন্ত্রে আইনসভা একটি প্রহসনমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
নির্বাচনের ক্ষেত্রেগণতন্ত্রে মূলত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমেই শাসকদের জনগণের সম্মতি নিতে হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকরা শাসিতের নিকট দায়িত্বশীল থাকে।একনায়কতন্ত্রে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবর্তে প্রহসনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ।
প্রাধান্যের ক্ষেত্রেগণতন্ত্রে জনগণের প্রাধান্যই প্রবল।গণতন্ত্রে মনে করা হয় ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র।একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতাসীন দল বা রাষ্ট্রের প্রাধান্যই প্রবল। একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রই চরম ও চূড়ান্ত ।
আইনের শাসনগণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কেননা গণতান্ত্রিক সরকার আইন অনুবর্তন ছাড়া কোন কার্য পরিচালনা করতে পারে না।একনায়কতন্ত্রে আইনের শাসনের বালাই নেই। শাসক শ্রেণির কথাই আইন। সর্বত্র অন্যায়, অত্যাচার, জুলুমের চিত্র দেখা যায়।
জাতীয়তাগণতন্ত্র আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী। একনায়কতন্ত্র উগ্রজাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।
ভিত্তিগণতন্ত্র জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা।একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও শক্তি।
সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেগণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সংখ্যালঘিষ্ঠের সম্মতির সাথে পরিচালিত হয়। এ সরকারের সংবিধানে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। সংখ্যালঘুদের মতামতকে সম্মান দেয়া হয়। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে সকলের সম্মতির উপর রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। একনায়কতান্ত্রিক সরকারে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
জনগণ ও সরকারগণতন্ত্রে জনগণ ও সরকার পরস্পর পরস্পরের আয়না স্বরূপ ভূমিকা পালন করে।একনায়কতন্ত্রে ঐরূপ কোন অবকাশ নেই। জনগণের মধ্যে সরকারের স্বরূপ প্রতিফলিত হয় না।
কল্যাণসাধন ক্ষেত্রেজনগণের কল্যাণসাধনই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার আসল উদ্দেশ্য এবং সেজন্যই জনগণ ও সরকার পরস্পরের কল্যাণ কামনা করে।একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় শাসকগােষ্ঠীর কল্যাণই সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয়। এজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে যদিও বলি দিতে হয় তাও স্বীকৃত।
শান্তিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রেগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় জনগণের শান্তিশৃঙ্খলা ও বিকাশধারার প্রতি গুরুত্বারােপ করা হয়।একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় কেবলমাত্র শৃঙ্খলার প্রতি গুরুত্বারােপ করত সংরক্ষক ও বিকাশ ধারাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা হয়।
রাষ্ট্রীয় সুযােগ সুবিধার ক্ষেত্রেগণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় সুযােগ সুবিধা সমতা ও সুষম গঠননীতির ভিত্তিতে বিতরণ করা সম্ভব।একনায়কতন্ত্রে তাঁ স্বজনপ্রীতির একরূপদর্শী আত্মসাৎমূলক নীতির ভিত্তিতে বিতরণ করা হয়
নেতৃত্বের ক্ষেত্রেগণতন্ত্র যৌথ নেতৃত্বে বিশ্বাসী।একনায়কতন্ত্র একক নেতৃত্বে বিশ্বাসী।
স্থায়িত্বের ক্ষেত্রেগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্থায়ী, শাশ্বত ও সর্বজনীন।একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অস্থায়ী।
দায়িত্বশীলতার দিক দিয়েগণতান্ত্রিক সরকার তার দায়িত্ব পালনের জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকে।একনায়কতন্ত্রে সরকার তার দায়িত্ব পালনে বা কার্যাবলির জন্য কারও কাছে দায়ী থাকে না।
গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য

গণতন্ত্রের সুফল ও কুফল

গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণার উৎস হল প্রাচীন গ্রীক রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত বহু বিদগ্ধ পন্ডিত ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনায় গণতন্ত্র সম্বন্ধে ধারণা বিকশিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে গণতন্ত্রের যেমন অন্ধ সমর্থক আছেন, তেমন ঘোরতর বিরুদ্ধবাদীরও অভাব নেই। গ্রীক পন্ডিত অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে বেন্থাম (Jeremy Bentham), টক্‌ভিল (A.D. Tocqueville), বার্কার (Ernest Barker), ব্রাইস (J. Bryce), ল্যাস্কি (H. J. Laski) প্রমুখ চিন্তাবিদ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তির অবতারণা করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের প্রশস্তিতে পঞ্চমুখ।

আবার কার্লাইল, লেকী, হেনরী মেইন, নীট্‌সে, ট্রিটস্‌কে, ব্লুণ্টস্‌লি প্রমুখ রাষ্ট্রনীতিবিদ্ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরূপ সমালোচনা করেছেন কঠোরভাবে। মার্কসীয় চিন্তাবিদ্‌গণ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিরোধিতা করলেও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে হলে এর পক্ষে ও বিপক্ষে প্রদর্শিত যুক্তিগুলি যথাযথভাবে অনুধাবন করা দরকার।

গণতন্ত্রের সুফল

(১) স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বই গণতন্ত্রের ভিত্তি: স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব (Theory of Natural Right) অনুসারে বলা হয় যে, প্রত্যেকেই তার নিজের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। এই স্বাভাবিক অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি তার শুভাশুভ নির্ধারণের সুযোগ পায়। প্রত্যেক ব্যক্তির ইচ্ছা রাষ্ট্র কর্তৃক বিবেচিত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে।

লাওয়েল বলেছেন: “In a complete democracy no one can complain that he has not a chance to be heard.” গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকলে সমান ও স্বাধীনভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগের সুযোগ পায়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। সমানাধিকারের নীতিটি এখানে তত্ত্বগতভাবে স্বীকৃত এবং বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিমাত্রেই নিজ যোগ্যতা অনুসারে আত্মবিকাশের পথ বেছে নিতে পারে। এখানে জন্মগত বা ধনগত বৈষম্যকে স্বীকার করা হয় না। বলপ্রয়োগের কোনো সুযোগ এখানে নেই। বস্তুত গণতন্ত্র সমুন্নত নৈতিক আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত।

(২) হিতবাদী তত্ত্বের সমর্থন: বেন্থাম, জেমস্ মিল প্রমুখ হিতবাদী (Utilitarians) রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ও গণতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থক। হিতবাদী তত্ত্বে বলা হয় যে, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক মঙ্গল সাধনই (greatest good of the greatest number) রাষ্ট্রের লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও এই মৌলিক উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। গণতন্ত্রে শাসনকার্য পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের করায়ত্ত থাকে। ফলে সরকারের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সকলেই ভোগ করার সুযোগ পায়।

বেন্থামের মতানুসারে সুশাসনের প্রধান সমস্যা হল শাসক ও শাসিতের স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান ও সর্বাধিক জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন। শাসিতকে শাসকের পদে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান ও সুশাসন সম্ভব হয়। কেবল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাতেই শাসিতকে শাসকের পদে উন্নীত করা যায়। এজন্যই হিতবাদী জেমস্ মিল-এর মতে গণতন্ত্র হল ‘বর্তমান যুগের সর্বোৎকৃষ্ট’ (grand discovery of modern times) I

(৩) আদর্শবাদের সমর্থন: আদর্শবাদী তত্ত্বে গণতন্ত্রের স্বীকৃতি ও সমর্থন পাওয়া যায়। আদর্শবাদে বলা হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় যেখানে ব্যক্তি আত্মবিকাশের সর্বাধিক সুযোগ পেতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের নিজস্ব সরকার। জনগণ নিজেরাই সরকার গঠন করে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করে এবং স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। এইভাবে মানুষ আত্মোপলব্ধির পথে অগ্রসর হয়; ফলে সুন্দর ও সমৃদ্ধ জীবন যাপন করা যায়।

(৪) ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা: গণতন্ত্র হল ন্যায়নীতি-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। গণতন্ত্রে দেশের সকল ব্যক্তি রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে। আলাপ-আলোচনার ভাব-বিনিময়ের মাধ্যমে সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বার্কার-এর মতানুসারে ‘গণতন্ত্র হল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা’ (Democracy….is a system of government by discussion.”)। এইভাবে সকলের সঙ্গে মতামতের আদান-প্রদানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়; সাম্য ও স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেয়ো (Henry B. Mayo)-র অভিমত হল: ‘গণতন্ত্র হল ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপযোগী সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা’ [(democracy) is the system best able to produce justice.]।

(৫) সর্বসাধারণের কল্যাণ: ল্যাস্কি (H. Laski)-র মতে জনকল্যাণ সাধন যদি সরকারের লক্ষ্য হয়, তবে রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতেই থাকা আবশ্যক। কারণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যে শ্রেণীর হাতে থাকে, সেই শ্রেণীর স্বার্থেই সরকার পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রেই কেবল রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে। তাই গণতারে সর্বসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলবিধানের জন্য সরকারী ক্ষমতা ব্যবহৃত। রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব বা বৈষম্যমূলক আচরণের আশঙ্কা থাকে না। এই হল রাষ্ট্রনৈতিক ন্যায়। এই কারণে গণতন্ত্র সকলের সমর্থন ও আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।

(৬) স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা: জন স্টুয়ার্ট মিলের মতানুসারে সুশাসনই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে জনগণের মানসিক উন্নতি সাধন করা দরকার। এ প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত উক্তি হল: “The best of all governments is which teaches us to govern ourselves.” একজন স্বৈরাচারী রাজা ব্যক্তিগত প্রশাসনিক দক্ষতার ভিত্তিতে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। কিন্তু এতে জনগণের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয় না এবং আত্মপ্রত্যয় ও দেশপ্রেম সৃষ্টি হয় না। কিন্তু গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের অবাধ সুযোগ রয়েছে। জনগণ শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এর ফলে সাধারণ মানুষ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে, প্রত্যেক ব্যক্তি প্রকৃত মর্যাদার অধিকারী হয়। লাওয়েল বলেছেন: “The best government in the long run is one that nurtures a people strong in moral fibre, integrity, industry, self reliance and courage.”

কোকার বলেছেন: “Participation in the control of public affairs removes the individual from narrow egotism and enlarges the range of his interest and imagination.” এককথায় জনগণের মানসিক উন্নতি সাধিত হয়। বস্তুত গণতন্ত্র ব্যক্তিজীবনে এক নতুন মূল্যবোধের সঞ্চার করে। তার ফলে ব্যক্তিজীবনে মর্যাদা ও সম্ভ্রমের সৃষ্টি হয়। এইভাবে ব্যক্তিগত জীবনে পূর্ণতা আসে এবং জাতীয় চরিত্র উন্নততর হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল মন্তব্য করেছেন: “It promotes a better and higher form of national character than any other polity whatever.” বার্নস (C. D. Burns) মন্তব্য করেছেন: “All government is a method of education but best education is self-education which is democracy.”

(৭) রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার: স্বতন্ত্র একটি যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে, গণতন্ত্রে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহণের সুযোগ পায়। তার ফলে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা যায়। এতে রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ঘটে। তা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে অপরিহার্য মনে করা হয়। এই রাজনৈতিক দলগুলি দেশের বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধান সম্পর্কে জনগণের সন্মুখে নিজ নিজ নীতি ও পরিকল্পনা পেশ ও বিশ্লেষণ করে। তাছাড়া বিরোধী দলগুলি সরকারী দলের কার্যাবলী সম্পর্কে জনগণকে অবহিত রাখে। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষও সকল বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকে। এইভাবে জনগণ রাষ্ট্রনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। এর – সুদূরপ্রসারী ফল হিসাবে জনকল্যাণধর্মী দায়িত্বশীল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৮) সংঘর্ষ ও বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে মুক্ত: গণতন্ত্রের সপক্ষে আরও একটি দাবি হল: এটি সংঘর্ষ বা বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে মুক্ত। এটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির আদর্শে অনুপ্রাণিত। গণতন্ত্রে ক্ষমতার উৎস হল ব্যালট এবং শাসনের ভিত্তি হল শাসিতের সম্মতি। সকল সরকারী সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপের পিছনে জনগণের নৈতিক অনুমোদন থাকে। তাই জনমনে ক্ষোভ সঞ্চারিত হতে পারে না। জনমতের চাপে সরকারী কার্যক্রম প্রভাবিত হয়। আবার প্রয়োজনবোধে জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তনও করতে পারে। এজন্য জনগণকে রক্তক্ষয়ী বৈপ্লবিক পন্থা অবলম্বন করতে হয় না। গণতন্ত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল সমস্যার সমাধান করা যায়।

(৯) দেশপ্রেমের সৃষ্টি হয়: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনকার্যে প্রত্যেকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকে। তা ছাড়া, গণতন্ত্রে সকলের স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগ থাকে। তাই সরকারকে তাদের নিজেদের সরকার হিসাবে ভাবতে শেখে। তার ফলে জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশ প্রীতির সৃষ্টি হয় এবং দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। এই দেশপ্রেম কালক্রমে আন্তর্জাতিকতার মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়।

(১০) সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থা হল জনমত-পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। জনমতের ভয়ে সরকার সাধারণত স্বৈরাচারী হতে পারে না। জনমতকে উপেক্ষা করলে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণও সরকারকে সংযত রাখে। প্রকৃত প্রস্তাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসিতের প্রতি শাসকের দায়িত্বশীলতা সুনিশ্চিত হয়।

(১১) স্থায়িত্ব: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সরকারের পিছনে জনসাধারণের ব্যাপক সম্মতি বর্তমান থাকে। সেজন্য গণতান্ত্রিক সরকার স্থায়ী হয়।

(১২) আইনের অনুশাসন: গণতন্ত্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল রকম বৈষম্যমূলক আচরণের পথ রুদ্ধ হয়। শাসক এবং বিচারকদেরও বৈষম্যমূলক ও অন্যায় কাজকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। গণতন্ত্রে সকল ক্ষেত্রে জনগণই হল চূড়ান্ত বিচারক। ড. ফাইনার বলেছেন: “We have the assurance that the sphere of our private life will not be invaded except by due process of law in which we have an equal say with any.”

(১৩) রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি: গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বাস্তবে কার্যকর হয়। গণতন্ত্রে জনগণই হল সকল ক্ষমতার উৎস। কেবল গণতন্ত্রেই জনগণ তাদের ইচ্ছানুসারে সরকার গঠন ও রদবদল করতে পারে। গণতন্ত্রে সরকার তার সকল কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে।

(১৪) দায়িত্বশীলতা: গণতন্ত্রে শাসিতের কাছে শাসক দায়িত্বশীল থাকে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে। আবার রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনসাধারণের কাছে দায়িত্বশীল থাকেন।

গণতন্ত্রের কুফল

বিভিন্ন গুণাবলীর অস্তিত্ব সত্ত্বেও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনার অভাব নেই। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর সময় থেকেই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিরুদ্ধবাদীদের মতে, গণতন্ত্র অপেক্ষা নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা বিরল। তাঁরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন।

(ক) অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শাসন: গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম ও প্রধান অভিযোগ হল এটি অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও অক্ষম ব্যক্তির শাসন। কারণ গণতন্ত্র হল জনগণের শাসন এবং জনগণের অধিকাংশই অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। অতএব যে শাসনব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকাই মুখ্য, তা গুণগত বিচারে নিম্নমানের হওয়াই স্বাভাবিক। লেকি তাই উপহাস করে বলেছেন: গণতন্ত্র হল ‘সর্বাপেক্ষা দরিদ্র, সর্বাপেক্ষা অজ্ঞ এবং সর্বাপেক্ষা অযোগ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা, কারণ তারাই হল সংখ্যায় সর্বাধিক’ (Democracy is a Government “by the poorest, the most ignorant, the most incapable, who are necessarily the most numer ous.”)। একই ভাবে কার্লাইল তীব্র কটাক্ষ করে বলেছেন: ‘গণতন্ত্র হল মূর্খদের, মূর্খদের জন্য এবং মূর্খদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা’ (“Democracy is a Government of the fools, for the fools and by the fools.”)। অজ্ঞ ও অশিক্ষিত জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও অনুরূপ প্রকৃতির হন। তাঁদের দ্বারা দক্ষ শাসন আশা করা যায় না।

(খ) সততা ও যোগ্যতার কদর নেই: একথা বলাই বাহুল্য যে, যে-কোনো শাসনব্যবস্থার সাফল্য শাসকবর্গদের বুদ্ধিমত্তা ও গুণগত যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। বর্তমান কালের সমস্যাসঙ্কুল ও জটিল শাসনব্যবস্থায় এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু গণতন্ত্রে সততা ও যোগ্যতার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। এখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যোগ্য-অযোগ্য, দক্ষ-অকর্মণ্য, সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। বরং অধিকাংশ সাধারণ মানুষ অশিক্ষিত ও অজ্ঞ বলে যোগ্য ও দক্ষ প্রতিনিধি বাছাই করতে পারেন না। তাঁরা ধূর্ত ও চতুর ব্যক্তিদের ভাঁওতায় বিভ্রাপ্ত হয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদেরই মনোনীত করেন। এর ফলে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ সরকার পরিচালনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এতে দেশে সুশাসনের সম্ভাবনা কমে যায়।

জার্মান দার্শনিক নীৎসে (Nietzsche) বলেছেন: গণতন্ত্র বলতে সাধারণ ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা এবং জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির প্রতি অবজ্ঞা বোঝায়’ (Democracy means ‘Worship of the mediocrity and hatred of excellence,” here “imitation is horizontal instead of vertical-not the superior man but mojority men becomes the ideal and the model.”)। গণতন্ত্রে গুণগত যোগ্যতার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অথচ জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হল অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। লেবঁ (Le Bon) গণতন্ত্রকে বলেছেন ‘Government by crowds.’ বার্নস (C. D. Burns)-এর মতানুসারে, “Civilisation which Democracy produces is banal, mediocre or dull.”

(গ) রক্ষণশীল: গণতন্ত্র শিক্ষিত ও অক্ষম ব্যক্তির শাসন। তাই এই শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে প্রগতিবিরোধী ও রক্ষণশীল। শিক্ষিত ও বিজ্ঞ ব্যক্তির মনেই প্রগতিশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটে। অপরদিকে অশিক্ষিত ও অজ্ঞ জনগণ নতুন চিন্তা-ভাবনা, আবিষ্কার, উদ্ভাবনের ব্যাপারে নিস্পৃহ এবং ঘোরতর বিরোধী। তারা প্রগতিমূলক পরিবর্তনের পরিপন্থী। স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য তাদের উৎসাহ লক্ষ করা যায়। এর ফলে গণতন্ত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত সংস্কার ব্যাহত হয়; প্রগতির বিরুদ্ধে রক্ষণশীলতাই জয়ী হয়। কোকার (F. W. Coker) মন্তব্য করেছেন: “Democracies are…the most conservative of all forms of state.”

(ঘ) দলপ্রথার কুফল: গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। দলীয় ভিত্তিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সেই দলই সরকার গঠন করে। ফলে কার্যত দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারী দল প্রায় ক্ষেত্রেই বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। দলীয় স্বার্থ সাধনের উদ্দেশ্যে জন-সাধারণের অর্থের ব্যাপক অপচয় হয়। অভিযোগ করা হয় যে, নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারী দল জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও ভোট সংগ্রহের জন্য সরকারী প্রশাসন ও অর্থকে অবাধে ব্যবহার করে। সরকারী অর্থের অপরিমিত অপচয়ের জন্য জনস্বার্থ অবহেলিত হয়, জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতার লোভে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। দলীয় শাসনের যাবতীয় কুফল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংকট সৃষ্টি করে। দলীয় আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশ্রয় পায়। ব্রাইস একে বলেছেন: “Under power of party organisation.”

(ঙ) স্বল্পস্থায়ী ও ক্ষণভঙ্গুর: স্থায়িত্বের ব্যাপারেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরূপ সমালোচনা করা হয়। হেনরী মেইন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ক্ষণভঙ্গুর ও স্বল্পস্থায়ী। গণতন্ত্রে বহু পরস্পর-বিরোধী মত ও ধারণা দেখা যায়। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এর ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোন স্থায়ী সরকার গঠন করা যায় না। অনেক সময় বহু-দলীয় কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এতে সরকার বিশেষভাবে দুর্বল ও স্বল্পস্থায়ী হয়। প্রায়ই একটি সরকারের পতন, আবার নির্বাচন এবং নতুন সরকার গঠিত হয়ে থাকে। ফলে কোনো সরকারই জনকল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ বা বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে না।

(চ) শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার বিরোধী: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হল যে, এই শাসনব্যবস্থা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে আনুকুল্য প্রদর্শন করে না। গণতন্ত্র হল সাধারণ মানুষের সরকার। কারণ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এতে প্রতিভার কদর বা মর্যাদা নেই। গণতন্ত্র বিজ্ঞ-অজ্ঞ সবাইকে সমপর্যায়ভুক্ত করে। বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রেও হাস্যকর সাম্য সৃষ্টির চেষ্টা করে। তাতে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানবুদ্ধির অপমৃত্যু ঘটে। ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর উৎকৃষ্ট শিল্পস্থাপত্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নত সৃষ্টিসমূহ কোনো-না-কোনো রাজার বিশেষ আনুকূল্যের ফলে সম্ভব হয়েছে।

মেইন (Henry Maine), লে ব (Le Bon), প্রভৃতি চিন্তাবিদের মতানুসারে গণতন্ত্র শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা প্রভৃতি মানুষের সুকুমার বৃত্তিসমূহের বিরোধী। লে. বঁ মন্তব্য করেছেন: “It is fortune for the progress of civilization that the power of crowds only began to exist when the great discoveries of science and industry had already been effected.”

(ছ) গণতন্ত্র হল নির্বাচক-মণ্ডলীর সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে যে সমুন্নত ও আদর্শ সরকারের কথা বলা হয় তাও বস্তুতপক্ষে অতিপ্রচার মাত্র। গণতন্ত্র সকলের সরকার নয়। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠেরও সরকার নয়। কার্যক্ষেত্রে গণতন্ত্র হল নির্বাচকমন্ডলীর সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা মাত্র। অন্যান্য শাসনব্যবস্থায়ও জনসাধারণ এই ক্ষমতা ভোগ করতে পারে। তবে গণতন্ত্রে জনগণের এই ক্ষমতা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

(জ) জরুরী অবস্থার অনুপযোগী: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হল এটি জরুরী অবস্থার উপযোগী নয়। কারণ এ শাসনব্যবস্থা মহর ও শ্লথ গতিসম্পন্ন। বহিরাক্রমণ, আভ্যন্তরীণ গোলযোগ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি সংকটপূর্ণ মুহূর্তে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এবং তৎপরতার সঙ্গে সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করতে হয়। গণতন্ত্রে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয়। তাই তা সম্ভব হয় না। গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বিলম্ব হয়। তার ফলে ইতিমধ্যে দেশের স্বার্থের প্রভূত ক্ষতি হয়। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দৃঢ়তার সঙ্গে জরুরী অবস্থার মোকাবিলা করা যায় না। এই ব্যবস্থা জাতীয় সংকটের মোকাবিলার উপযোগী নয়।

(ঝ) নৈতিক অবনতি ঘটে: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নৈতিকতার ক্রমশ অধঃগতি ঘটে। গণতন্ত্র হল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই হল অজ্ঞ ও অশিক্ষিত এবং রাজনৈতিক জ্ঞান-রহিত। এই অবস্থায় চতুর, বাকপটু ও স্বার্থপর কিছু নেতা মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন হন। নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতি, উৎকোচ প্রদান ও গ্রহণ প্রভৃতি অবাধে চলতে থাকে। সাধারণ মানুষ দুর্নীতি ও প্রলোভনের শিকার হয়। অনৈতিক কাজকর্মে সমাজজীবন ছেয়ে যায়। রাজনৈতিক ভাঁড়ামি এবং স্বার্থের রাজনীতিতে দেশ ছেয়ে যায়। আসির বাথম বলেছেন: “Democracy is a process of diseducation. It flatters people. It engenders people a false sence of equality.”

(ঞ) নিম্নস্তরের নেতৃত্ব: উপরিউক্ত কারণের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অযোগ্য ব্যক্তিরা নেতৃত্ব লাভ করেন। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব স্থিরীকৃত হয়। তাই অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তিরাই নেতৃত্ব পেয়ে থাকেন। ঐতিহাসিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে র‍্যাল্ফ অ্যাডাম ক্র্যাম প্রতিপন্ন করেছেন যে অতীতের নেতৃত্বের থেকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মান নিচু। ফরাসি চিন্তাবিদ ফ্যাগুয়েও সমমত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন: “Government is an art and it presupposes knowledge, but the people are governed by men who have neither knowledge nor are and were chosen because they have them not.”

(ট) জীবনবিজ্ঞানের সমালোচনা: জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ‘বন্য, সাধারণ ও স্থূল’ সভ্যতার উপযোগী বলে সমালোচনা করা হয়েছে। আয়ারল্যান্ড (Alleyane Ireland), প্রেস্ফুট হল (Prescott Hall) প্রমুখ জীবনবিজ্ঞানীর মতানুসারে গণতন্ত্রে ব্যক্তির গুণগত পার্থক্যকে স্বীকার করা হয় না। জন্মগতভাবে মানুষে মানুষে পার্থক্য বর্তমান। কিন্তু গণতন্ত্র ‘সব মানুষ সমান’—এই সাম্যনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই নীতি অবৈজ্ঞানিক। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং মননশীলতা ও প্রতিভার পার্থক্য অস্বীকৃত হওয়ায় গণতান্ত্রিক সভ্যতাও নিম্নস্তরের হয়ে থাকে।

(ঠ) পুঁজিবাদের ত্রুটি: অনেকের মতে গণতন্ত্রে পুঁজিবাদ প্রশ্রয় পায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, যে সকল দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আছে বলে দাবি করা হয়, সেই সব দেশে রাজনৈতিক সাম্য থাকলেও অর্থনৈতিক সাম্য থাকে না। তার ফলে অর্থনতিক বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক সাম্য মূল্যহীন হয়ে পড়ে। দেশের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিত্তবান পুঁজিপতিদের করায়ত্ত হয় এবং তাদের স্বার্থেই প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়।

(ড) আমলাতন্ত্রের ত্রুটি: আবার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ত্রুটি দেখা যায়। গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের সুষ্ঠু প্রশাসন কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থাকে না। তা ছাড়া, জনসমর্থন অটুট রাখার জন্য প্রতিনিধিরা শাসনকার্যে আত্মনিয়োগ না করে রাজনৈতিক কার্যকলাপে বেশি সময় ব্যয় করেন। ফলে প্রশাসনিক ব্যাপারে তাঁরা আমলাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আর আমলাদের প্রাধান্য-প্রতিপত্তির জন্য জনসাধারণের স্বার্থ অবহেলিত হয়।

(ঢ) ব্যয়বহুল: অনেকের মতে গণতন্ত্র হল একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। ঘন ঘন নির্বাচনের ব্যবস্থা, জনমত গঠন, ব্যাপক প্রচারকার্য প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভৃতি বিভিন্ন ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়। আর এই ব্যয় অর্থের অপচয় বই কিছু নয়। 

(গ) সংখ্যালঘুদের স্বার্থের অবহেলা: আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ অবহেলিত হওয়ার অভিযোগও করা হয়। বাস্তবে গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। সংখ্যালঘুরা সাধারণত আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে না। ফলে তাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সরকার উদাসীন থাকে।

(ত) আবেগের তাড়না: গণতন্ত্রে জনগণের আবেগের আধিক্য দেখা যায়। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক চেতনা ও যুক্তির বদলে উচ্ছ্বাস ও ভাবালুতার দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী গিডিংস একে বলেছেন, ‘Unbridled emotionalism’। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আবেগ উচ্ছ্বাস বিপথগামী হয়।

বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও গণতন্ত্রই হল বর্তমানে বিশ্ববন্দিত শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে উল্লিখিত সমালোচনাগুলির কতকগুলি গণতন্ত্র সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত। আর বাকিগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক। সাধারণ মানুষের অধিকাংশই অশিক্ষিত, একথা ঠিক। কিন্তু তাই বলে অজ্ঞ—একথা বলা যায় না। কারণ স্কুল-কলেজের পাঠক্রমের সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতার তেমন ঘনিষ্ঠ কোনো সংযোগ নেই।

বাস্তবে এমন নজির অসংখ্য। তা ছাড়া জনগণের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারের জন্যও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই বিশেষভাবে উপযোগী। তবে গণতন্ত্রকে একেবারে ত্রুটিমুক্ত শাসনব্যবস্থাও বলা যায় না। কিন্তু গণতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি সংশোধনযোগ্য এবং এগুলি দূর করা দরকার। যাইহোক, ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও গণতন্ত্র বর্তমান দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত।

লিপসন মন্তব্য করেছেন। “….of all forms of Government known and tried, democracy is the wisest and the best.” পরিশেষে বার্নস (C. D. Burns )-এর মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “No one denies that existing representative assemblies are defective; but even if an automobile does not work well, it is foolish to go back to farm cart, however romantic.”

আরো অন্যান্য সরকারি স্কিম সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | গণতন্ত্র

Q1. গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য কি

Ans – জনকল্যাণ সাধন, গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য।

Q2. গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলা হয় কাকে

Ans – হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (সেপ্টেম্বর ৮,১৮৯২-ডিসেম্বর ৫,১৯৬৩) গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলা হয় ।

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।