সংস্কৃতি কি, সংস্কৃতি কাকে বলে, সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি, লোক সংস্কৃতি কি

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

সংস্কৃতি কি

সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনযাপন, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ভাষা পদ্ধতি, যোগাযোগ এবং আচর-আচরণ, এ সবগুলোর সমষ্ঠিকে সংস্কৃতি বলা হয়। ‍যদিও সংস্কৃতি একটি জটিল ধারণা, তবে এটি সচেতনভাবে এবং অবচেতনভাবে উভয়ভাবেই আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককেই প্রভাবিত করে।

আরো সহজভাবে সংস্কৃতির সংজ্ঞা হলো কোনও জাতি বা গোষ্ঠির চিন্তাভাবনা, আচরণগত দিকনিদর্শ, পোশাক, ভাষা, খাদ্য, ধর্ম,সংগীত, অঞ্চল বা ভূগোল ইত্যাদির সমষ্ঠি।

সংস্কৃতিকে মানুষের জীবনযাত্রার রূপ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। যেমন: কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকেরা কীভাবে চিন্তা করে, কীভাবে তারা কাজ করে, তাদের আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, পোশাক, তাদের কথা বা ভাষা, তাদের ধর্মীয় ক্রিয়াকালাপ, সংগীত, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়গুলো মিলিত হয়ে একটি সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়।

আমরা সংস্কৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করি না, আমরা মূলত নির্দিষ্ট একটি সংস্কৃতিতে জন্মেছি এবং সামাজিকভাবে বাসবাস করার মাধ্যমে আমরা সংস্কৃতি শিখি বা ধারণ করি। আর সংস্কৃতি এমন এক জিনিস যা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রমণিত হয়। আমরা সংস্কৃতি যাকে বলি তার বেশিরভাগই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় এবং সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সংস্কৃতির উন্নতি হয় বিভিন্নভাবে। যেমন; নতুন নতুন জিনিস তৈরির মাধ্যমে, নতুন চিন্তাভাবনার মাধ্যমে অথবা নতুন কিছু আবিষ্কারের মাধ্যমে।

সংস্কৃতি কাকে বলে

বাংলা সংস্কৃতি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো (culture)।

ষোল শতকের শেষার্ধে ফ্রান্সিস বেকন তার ইংরেজি সাহিত্যে (culture) শব্দটি সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেন। তারপর উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে বিজ্ঞানী ওয়ার্ল্ড ইমার্সন (culture) শব্দের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। সংস্কৃতি শব্দের বাংলা অর্থ হলো কৃষ্টি। কৃষ্টি শব্দের অর্থ হলো চাষ বা “কর্ষণ”।

এককথায় “মানবসৃষ্ট সমস্তকিছু নিয়েই” সংস্কৃতি।

ব্যাপকঅর্থে, মানুষের নীতিবোধ, ভাবধারা, ভাষা, আইন এবং নানা প্রকার হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি এবং মানুষের বেঁচে থাকার সমস্ত প্রকার কূটকৌশলসহ সমস্ত কাজের সমষ্টি নিয়েই সংস্কৃতি। সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে সংস্কৃতিকে কৃৎকৌশল বলে উল্লেখ করেছেন।

সামাজিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে, মানবসৃষ্ট সমস্তপ্রকার বস্তুগত ও অবস্তুগত উপকরণ নিয়েই আমাদের সংস্কৃতি। উৎপাদনশীল সমস্ত প্রকার যন্ত্রপাতি ও উপাদানসমূহ যেমনঃ কলকারখানা, হাতিয়ার, মানব শ্রম, ব্যবস্হাপনা, শ্রেণী-সম্পর্ক এসব নিয়ে যেমন বস্তুগত সংস্কৃতি গড়ে উঠে ঠিক তেমনি সাহিত্য, শিল্পকলা, কারুশিল্প, চারুকলা, বিজ্ঞান, ব্যবস্হাপনা এসব নিয়ে অবস্তুগত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। যদিও সংস্কৃতি শব্দটি একটি বৃহৎ প্রত্যয়, তাই এখানে বস্তগত ও অবস্তুগত উভয়প্রকার সংস্কৃতির প্রভাব বিরাজমান।

সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও

ই.বি টেইলর (E.B. Taylor) এর মতে, “culture is that complex whole which include knowledge, belief, art, moral, law, custom and any other capabilities and habits acquired by a man as a member of society”. অর্থাৎ সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-আচরণ, ব্যাবহার, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, রীতি-নীতি, প্রথা,আইন ইত্যাদির জটিল সমাবেশ হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির অন্যসব সংজ্ঞায়নের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি গ্রহনযোগ্য। এই অনুসারে সংস্কৃতি হলো ব্যাক্তির আচার এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অর্জিত সকল গুনাবলি। মানুষ সংস্কৃতির বিষয় গুলো ধীরে ধীরে গ্রহণ করে।

এই গ্রহণ প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্টানিক, সচেতন ও অসচেতনভাবে সম্পন্ন হয়। ম্যালিনোস্কি (Malinowski)এর মতে, “culture is the handiwork of man through which he achieves his ends”. অর্থাৎ মানুষের এমন সব কর্মই সংস্কৃতি যার দ্বারা সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। মানুষ তার অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে যা কিছু সৃষ্টি করেছে তাই সংস্কৃতি।

হোবল (Hoebel) এর মতে, ” culture is the sum total of integrated learned behaviour patterns which are characteristics of the members of society and which are therefore not the result of biological inheritance”.অর্থাৎ সমাজের একজন সদস্য হিসেবে সার্বিক জীবনে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত আচার-আচরণই হলো সংস্কৃতি যা জন্মগত বা সহজাত নয়।

বিভিন্ন গবেষক ও লেখকগণ সংস্কৃতির ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্নভাবে:-

  • ১. শালম স্কয়ার্টজ, বলেছেন: “সংস্কৃতি মানে একটি সমাজের মানুষের মধ্যে প্রচলিত অর্থ, বিশ্বাস, অনুশীলন, প্রতীক, মান এবং মূল্যবোধের একটি সমৃদ্ধ জটিল”
  • ২. G.H. HOFSTEDE, বলেছেন: “মনের একটি সম্মিলিত প্রোগ্রামিং যা একটি মানব দলের সদস্যকে অন্যের থেকে আলাদা করে”

সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সামাজিক ব্যবস্থা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক শৃঙ্খলা নিয়মকানুনের সম্মিলিত চুক্তির ভিত্তিতে সমাজের স্থায়িত্বকে নির্দেশ করে যা আমাদেরকে সমাজ হিসাবে কাজ করতে, সমাজ হিসাবে বসবাস করতে এবং শান্তি এবং সম্প্রীতিতে একত্রে থাকতে দেয়। 

সংস্কৃতি বলতে কি বোঝো

একজন মানুষের পরিশীলিত মন মার্জিত রুচি ও ব্যাবহারই হলো সংস্কৃতি। অন্যভাবে বলতে গেলে সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ যে সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করে তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো culture। এই culture শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ colere(কর্ষণ) থেকে।

অতিপরিচিত সংস্কৃতি প্রত্যয়টির ব্যাবহার এবং বিস্তৃতি ব্যাপক। কোনো একটি সমাজে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটির চরিত্র, মন কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয় এই সংস্কৃতি। এই ব্যাপক একটি বিষয় কে কোনো নিদিষ্ট সংজ্ঞায়নের মধ্যে আনাটাও অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ।সংস্কৃতি কে অনেকে অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন আমরা তার মধ্য থেকে কিছু সংজ্ঞায়ন নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।

সমাজতাত্ত্বিকগণ সংস্কৃতি কে দেখেছেন মানুষের সার্বিক জীবন প্রণালী হিসেবে(the way of life), অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো আমাদের গোটা জীবন ধারা।এ প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী ম্যাকাইভার (macIver) বলেন, ” culture is what we are and civilization is what we use or have.” অর্থাৎ আমরা যা তাই সংস্কৃতি এবং আমাদের যা আছে অথবা আমরা যা ব্যাবহার করি তা হলো সভ্যতা।

মূলত মানুষের চিন্তা-ভাবনা, কল্পনা, আচার-আচরণ ইত্যাদি কে বোঝানোর জন্য সংস্কৃতি প্রত্যয়টি ব্যাবহার করা হয়েছে। এখানে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে একই সারিতে দেখানো হয়েছে ফলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক দেখানোর প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়।

সভ্যতাকে সহজ ভাবে বলতে গেলে বলা যায় সভ্যতা মানুষের এমন এক সাফল্য যা উচ্চতর সংস্কৃতি কে নির্দেশ করে।একটি সংস্কৃতিতে সভ্যতার অস্তিত্ব থাকে না কিন্তু সভ্যতার অস্তিত্ব মাত্রই আমরা একটি পরিশীলিত সংস্কৃতিকে কল্পনা করতে পারি।

উদাহরণস্বরুপ, আমরা হয়তো মেহেরগড় সভ্যতার নাম শুনে থাকতে পারি। এটি হলো একটি আদিম কৃষি ভিত্তিক সমাজ। এই মেহেরগড়কে অনেক ইতিহাসবিদ সভ্যতার মর্যাদা দেন না বরং একটি সংস্কৃতি হিসেবে পরিচয় করান। দার্শনিক কান্ট সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে যে,” সভ্যতা হলো মানুষের বাহ্যিক আচরণ। সভ্যতার প্রতিফলন সুস্পষ্ট। কোনো দেশের চাকচিক্য দেখে সে দেশের সভ্যতা সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা যায়।

অপরদিকে সংস্কৃতি হলো মানুষের ভেতরের দিক। কোনো দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে সে দেশের মানুষের নিবিড় সংস্পর্শে আসা প্রয়োজন”। অর্থাৎ সংস্কৃতি আমাদের দক্ষতা,জ্ঞান, ধ্যান-ধারণার ও আচার-আচরণে অর্থাৎ মনোজগত কেন্দ্রিক বিষয়কে নির্দেশ করে।অন্যদিকে সভ্যতার একটি যান্ত্রিক প্রতিফলন রয়েছে। মানুষের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা পুরণের একটি বিশেষ কৌশল হলো সভ্যতা।

জোনস (jones) এর মতে, “culture is the sum of man’s creations”. অর্থাৎ মানবসৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি।মানুষ তার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে প্রাচীনকাল থেকে যা কিছু সৃষ্টি করে আসছে তার সবটাই সংস্কৃতি। ক্লুখন(kluckhon) এর মতে,”culture is the total life way of a people”.অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো মানুষের সার্বিক জীবন পদ্ধতি। সমাজের মানুষ তার জীবনে যা করে।সেটাই সংস্কৃতি হিসেবে পরিগনিত হবে।

“মার্ক্সীয় ধারণায় সংস্কৃতি মূলত অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত। সংস্কৃতি হলো উপরি কাঠামো।মৌল কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে উপরি কাঠামো। মৌল কাঠামো হচ্ছে সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি।কোনো সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যাবস্থার উপর ভিত্তি করে সে সমাজের সংস্কৃতি গড়ে উঠে”।

ম্যাক্স ওয়েবার( max weber) এর মতে সংস্কৃতি উন্নয়নের গতি প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ সংস্কৃতি কে একটি ব্যবস্থা ও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।যেখানে এই ব্যবস্থাগুলো আন্তঃসম্পর্কিত এবং প্রত্যেকটি সমাজের ক্রিয়াগত প্রয়োজন পূরণ করে। ট্যালকট পারসন্স (Talcott parsons) এর মতে, ” culture is a product and also a determinant of human interaction”.অর্থাৎ মানব মিথস্ক্রিয়ার ফল বা নির্ধারকই হলো সংস্কৃতি। তার মতে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য তিনটি। এগুলো হলোঃ

  • ১. সংস্কৃতি কোনো একক বিষয় নয়। এটি কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অভিন্ন সম্পদ, যা বিভিন্ন ভাবে এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে ব্যাপ্তি লাভ করে।
  • ২. সংস্কৃতি কোনো জন্মগত বা সহজাত বিষয় নয়। সংস্কৃতি শিক্ষালব্ধ।
  • ৩. সংস্কৃতি গতিশীল। এটি একস্থান থেকে অন্যস্থানে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে অনুপ্রবেশ করে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে যেকোনো প্রকার উদ্ভাবনই সংস্কৃতি।

আরো পড়তে: সভ্যতা কি, সভ্যতা কাকে বলে, সভ্যতার উপাদান কয়টি

সংস্কৃতির উপাদান গুলো কি কি

সংস্কৃতির উপদান গুলো সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত দিয়েছেন। এখানে দুইজনের মত তুলে ধরা পূর্বক সংস্কৃতির উপাদান গুলো আলোচনা করা হলো-

H. M. Johnson এর মতানুযায়ী সংস্কৃতির উপাদান গুলো হলো-

a. Cognitive Elements বা জ্ঞানগত উপাদান।

b. Beliefs বা বিশ্বাস।

c. Norms and Values বা আদর্শ ও মূল্যবোধ।

d. Signs বা সংকেত।

e. Non-normative ways of behaving বা আচরণের অ-আদর্শিক উপায়।

Depaul University এর সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক Richard T. Schaefer তাঁর ‘Sociology’ গ্রন্থে সংস্কৃতির উপাদান গুলোকে নিম্নোক্তভাবে দেখিয়েছেন:

a. Language;

b. Norms;

e. Sanctions;

d. Values.

নিম্নে সংস্কৃতির উপাদান সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

১. জ্ঞানগত উপাদান (Cognitive elements)

সকল সমাজের সংস্কৃতি এমনকি Literate এবং Pre-literate সমাজে যারা অন্তর্ভুক্ত তারা বিশ্বের বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার সম্পর্কে অবগত। এ জ্ঞানভাণ্ডার বা সম্পদ Cognitive Elements এর সাথে সম্পর্কিত। এমনকি আদিম বা অনক্ষর সমাজের লোকেরা যেমন- আন্দামান দ্বীপবাসীরা বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিল। তাদের এ জ্ঞান। হচ্ছে বাস্তবমুখী জ্ঞান।

২. বিশ্বাস (Beliefs)

এটি সংস্কৃতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশ্বাস বলতে পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে ব্যক্তির স্থায়ী প্রত্যক্ষণ, ধারণা ও জ্ঞানকে বুঝায়। অন্য কথায়, বিভিন্ন বস্তু সম্বন্ধে ব্যক্তির উপলব্ধি এবং জ্ঞানের সমন্বিত রূপকেই বিশ্বাস বলা যেতে পারে।

৩. আদর্শ ও মূল্যবোধ (Norms and values)

বিশেষ কোন অবস্থায় মানুষ কিভাবে কাজ করে, চিন্তা বা অনুভব করে সে সম্পর্কিত সমাজের যে আকাঙ্ক্ষা তারই নাম আদর্শ। R. T. Schaefer তাঁর ‘Sociology’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “Norms are established standards of behaviour maintained by a or a culture.” অর্থাৎ, সমাজ বা সংস্কৃতি কর্তৃক কাঙ্ক্ষিত এবং আচরণ বিধিই হলো আদর্শ।

অন্যদিকে, সত্যমিথ্যা, ঠিকবেঠিক, ভালোমন্দ, কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সমাজের সদস্যদের ধারণার নামই মূল্যবোধ। আর. টি. শেফার (R. T. Schaefer) এর মতানুযায়ী বলা যায়, “Cultural values are these collective conceptions of what is considered good, desirable and proper or bad, undesirable and improper in a culture. ” অর্থাৎ, ভালোমন্দ, কাঙ্ক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং ঠিকবেঠিক সম্পর্কে সংস্কৃতিতে বিদ্যমান ধারণার নামই মূল্যবোধ। প্রতিটি সমাজ ও সংস্কৃতির নিজস্ব আদর্শ ও মূল্যবোধ রয়েছে। এসব আদর্শ ও মূল্যবোধ গড়ে উঠে সমাজজীবনে দীর্ঘদিন একত্রে বসবাস করার মানবীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

৪. ভাষা (Language)

প্রত্যেক সংস্কৃতির ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। জাতি-বর্ণ, শ্রেণীভেদে ভাষা সকলকে একত্রীভূত করে। ভাষার মাধ্যমেই সংস্কৃতি প্রস্ফুটিত হয়। Bottomore এর মতে, ভাষা হচ্ছে সমাজকাঠামোর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দিক। বস্তুত ভাষা হচ্ছে সকলের সামাজিক অস্তিত্বের ভিত্তিস্বরূপ এবং চেতনার বাহনস্বরূপ।

৫. অনুমোদন (Sanctions)

“Sanctions are penalties and rewards for conduct concerning a social norm.” অর্থাৎ, এটি হলো আইন অমান্য করার শাস্তি বা এটি পালন করার পুরস্কার এবং তা সামাজিক আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত।

৬. লোকাচার এবং অবশ্য পালনীয় লোকরীতি (Folkways and mores)

সমাজের স্বাভাবিক গতিধারায় যেসব আচার-আচরণ, প্রথা, রীতিনীতি ও জীবনধারা গড়ে উঠে তাই Folkways বা লোকাচার। ম্যাকাইভার (MacIver) এর ভাষায়, “Folkways are the recognized or accepted ways of behaving in society.” অর্থাৎ, আচরণ এবং ব্যবহারের স্বীকৃত এবং গৃহীত পদ্ধতিই হচ্ছে Folkways বা লোকাচার। মানুষ এর মাধ্যমে নিজেকে পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে নেয়। আর মানুষের সামাজিক পরিবেশের অন্য নামই হচ্ছে সংস্কৃতি।

সমাজের সদস্যদের সমাজ নির্ধারিত নিয়ম ও আচরণবিধি এবং আদর্শ যা অবশ্য পালনীয় তাকে Mores বা অবশ্য পালনীয় লোকরীতি বলে। কোন Folkways মেনে না চললে কাউকে সামাজিক শাস্তি ভোগ করতে হয় না। কিন্তু Mores অমান্য করলে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। এটি সমাজের সংস্কৃতির অনুশাসনের একটি দিক।

৭. সংকেতায়ন (Signs)

Signs এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে Signals এবং Symbols. এ দু’য়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। No Parking লিখিত কোন Placard হচ্ছে Signal. কেননা একটি নির্দেশিত স্থানে কোন ধরনের গাড়ি না রাখার নির্দেশ প্রদান করে। কিন্তু Placard এ ব্যবহৃত শব্দটি Symbols কে প্রতিনিধিত্ব করছে।

সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি

সংস্কৃতির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে –

(১) সংস্কৃতি পারস্পরিক আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে অবস্থান করলেও এটির বিকাশ ঘটে মন দিয়ে শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে—কেননা সংস্কৃতি অনুধারণের বিষয়। আচরণগত দিকগুলি আত্মপ্রকাশিত হয় পোশাক-পরিচ্ছেদে, অলঙ্কারে, খাদ্য গ্রহণে, রন্ধন প্রক্রিয়ায়, সঙ্গীতে, বাক্যালাপে প্রভৃতিতে।

(২) সংস্কৃতি হল পুরোপুরি সামাজিক বিষয়। এটি পারস্পরিক বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে সমাজে অবস্থান করে। সমাজবিজ্ঞানে এই সংস্কৃতি বিনিময়কে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে সেই সঙ্গে সংস্কৃতিকে ব্যক্তিগত শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত করতে হয় ।

(৩) সামাজিকীরণ সংস্কৃতির অন্যতম বাহন বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি সামাজিক মানদন্ডে ‘মানুষ’ বলে গণ্য হন।

(৪) সংস্কৃতিকে কোন ব্যক্তিগত গন্ডীর মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না। বা ব্যক্তিগত অনুশীলনের বিষয়বস্তু হিসাবেও চিহ্নিত করা যায় না। সংস্কৃতি হল সমগ্র গোষ্ঠী-জীবনের, সমাজ জীবনের এটি সামাজিক বিষয়। সমাজে বসবাসের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতির উপাদানগুলি ব্যক্তির কাছে প্রকাশ পায়। ব্যক্তি প্রচলিত সংস্কৃতিতে বড় হয় এবং একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ তুলে ধরে।

(৫) সংস্কৃতি হল সমাজের কতকগুলি মৌলিক আচার-বিধির একত্রিতরূপ। এগুলি লোকাচার, বিশ্বাস, লোকনীতি,মূল্যবোধ আদর্শসমূহ প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থান করে এবং ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে।

(৬) সংস্কৃতি হল মানুষের আচরণবিধি নিয়ন্ত্রক। এর দ্বারা ব্যক্তি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সহজে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে।

(৭) সমাজে সংস্কৃতি নানাবিধ প্রথার মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়িত হয়। তাই এর কোন লিখিত ভিত্তি নেই। তবে সাংস্কৃতিক মানদন্ডগুলি অনেকসময় বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা স্বীকৃত হয়। এগুলি সাহিত্য, শিল্পকলা, ক্রীড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রথাসিদ্ধ বাস্তবায়ণের রীতি প্রচলিত থাকলেও এর পশ্চাতে কিছু বিধিবদ্ধ আইনি সুযোগ সুবিধাও থাকে।

(৮) সংস্কৃতি সমাজভেদে এবং সম্প্রদায়গতভাবে পৃথক হয়। এজন্য সাংস্কৃতিক মানদন্ডে স্বতন্ত্রতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

(৯) সংস্কৃতি কোন প্রকার নিষ্ক্রিয় বা নিশ্চল বিষয় নয়। এটি পরিবর্তন সাপেক্ষ। আমাদের ধ্যান-ধারনা, শিক্ষা, বিজ্ঞান, মতাদর্শ ইত্যাদি পরিবর্তনের সঙ্গে সংস্কৃতির অবস্থানও পাল্টায়। তাছাড়া একটি সংস্কৃতি আর একটি সংস্কৃতির কাছাকাছি এসে তার সংস্কৃতিগত অবস্থান পরিবর্তিত হতে পারে ।

সংস্কৃতি কত প্রকার, সংস্কৃতি কত প্রকার ও কি কি

সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য এবং অভিন্ন হলেও বিশ্লেষণের জন্য একে ভাগ করা হয়ে থাকে। 

(1) অর্থনৈতিক চাহিদা

(2) কাম-যৌন ইচ্ছা

(3) মোক্ষ আধ্যাত্মিক ইচ্ছা।

উপরিউক্ত ইচ্ছাপূরণে সমাজ-স্বীকৃত ব্যবহার প্রধান ভূমিকা নেয়—এই ব্যবহারকে ‘আচার’ বলা হয়। সামাজিক আচারকে তিনি আবার চারটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন যেমন – (a) বাস্তু বা বিষয় সম্পত্তি, (b) ক্রিয়া-ব্যবহারিক কর্ম, (c) সংহতি-সামাজিক কার্যক্রম এবং (d) তত্ত্ব-ধ্যান-ধারণা।

আবার অনেক নৃ-বিজ্ঞানী মানুষের কর্মধারাকে সংস্কৃতির শ্রেণী   বিন্যাসে বিবেচনা করে থাকেন। কর্মধারা বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন অথবা পরিবেশ অনুযায়ী মানুষ বিভিন্ন কর্মধারা, কলা-কৌশল ও পেশা ও পেশা গ্রহণে বাধ্য হয়। 

লোক সংস্কৃতি কি

লোক সংস্কৃতি হলো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত তাদের চিন্তায় ও কর্মের ঐতিহ্যনুসারে বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্টীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান, জীবন-যাপন প্রণালী, শিল্প ও বিনোদন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা সংস্কৃতিকে সহজ ভাষায় লোকসংস্কৃতি বলা হয়।

আরও সহজ ভাবে বললে লোক সংস্কৃতি হলো কোনো নিদির্ষ্ট এলাকায় বসবাস রত মানুষের মুখে মখে প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাস , আচার, রীতি-নীতি ও তাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টিই হলো লোক সংস্কৃতি।

লোকসংস্কৃতি ভাগ বা উপাদান নিছে দেয়া আছে, লোক সংস্কৃতির উপাদান –

(১) বন্তুকেন্দ্রিক

(২) বিশ্বাস অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক

(৩) খেলাধূলা কেন্দ্রিক

(৪) বাক্‌কেন্দ্রিক

(৫) অঙ্গ-ভঙ্গি কেন্দ্রিক

(৬) লিখন বা অঙ্কন কেন্দ্রিক।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি

রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবক্তা হলেন গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড। তিনি তাঁর “Comparative Political System” শীর্ষক রচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সংস্কৃতি কথাটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন লেখক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিষয়টিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা শুধু কাঠামোর দিক থেকেই অন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে আলাদা তা নয়; বরং এর আলাদা হওয়ার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। আর সেই গুরুত্বপূর্ণ দিকটিই হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ গত শতকের পঞ্চাশের দশকে রাজনৈতিক মতাদর্শ, জাতীয় নীতি, জাতীয় রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব ও মূল্যবোধ প্রভৃতি বিশ্লেষণের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাপক প্রয়োগ শুরু করেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্র অত্যন্ত সফলভাবে এগিয়ে গেছে, তবে চর্চার অভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এটি তেমন সফল হতে পারেনি।

আরো অন্যান্য প্রশ্নোত্তরের সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | সংস্কৃতি

Q1. সংস্কৃতি মানে কি

Ans – সংস্কৃতি হল পুরোপুরি সামাজিক বিষয়। এটি পারস্পরিক বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে সমাজে অবস্থান করে।সংস্কৃতিকে কোন ব্যক্তিগত গন্ডীর মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না।সংস্কৃতি হল সমাজের কতকগুলি মৌলিক আচার-বিধির একত্রিতরূপ।

Q2. বিদ্যালয় সংস্কৃতি মানে কি

Ans – সাধারণ অর্থে বিদ্যালয় সকল পাঠসহায়ক পরিবেশকে বোঝায় বলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুর সাধারণ নামই বিদ্যালয়। কিন্তু সাধারণ্যের কাছে বিদ্যালয় শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণী থেকে বা প্রাক-বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম কিংবা দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য।

Q3. ভৌতিক সংস্কৃতি কি

Ans – বস্তুগত সংস্কৃতি হল সংস্কৃতির একটি দিক যা একটি সমাজের ভৌত বস্তু এবং স্থাপত্য দ্বারা প্রকাশিত হয়। শব্দটি প্রাথমিকভাবে প্রত্নতত্ত্ব এবং নৃতত্ত্বে ব্যবহৃত হয়।

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।