মেহেরগড় সভ্যতা, মেহেরগড় সভ্যতা কে আবিষ্কার করেন, মেহেরগড় সভ্যতা কোন যুগের সভ্যতা

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মেহেরগড় সভ্যতা কে আবিষ্কার করেন

১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কৃত হওয়ার পর ইতিহাসিকবিদরা এর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে মেহেরগড় সভ্যতায় ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা। ১৯৭০ এর দশকে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জা৺ ফ্রান্সোয়া জারিজ ও তার সহকর্মীরা, মেহেরগড় সভ্যতার সন্ধান পান। প্রত্নতত্ত্ববিদদের সঙ্গে যোগদান বিজ্ঞানীরা। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় মেয়ের কর সভ্যতার আবিষ্কার ও প্রাচীন তত্ত্ব নির্ণয় সম্ভব হয়েছে। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত সাইন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় এই সভ্যতা সম্পর্কে এক প্রবন্ধে আলোকপাত করা হয়। পরে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব প্রত্যাত্ত্বিক সম্মেলন এই মেহেরগড় সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা হয়।

মেহেরগড় সভ্যতা ছিল নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা যা ভারতের একটি প্রাচীনতম সভ্যতাও বটে। জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ ১৯৭৪ সালে বালুচিস্তানের বোলান নদীর তীরে মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন।

মেহেরগড় সভ্যতা ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ এবং রিচার্ড মিডৌ আবিস্কার করেন। এখন এটি বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা হিসাবে পরিচিত। এই সভ্যতা আবিষ্কৃত হওয়ায় ভারতের ইতিহাসের প্রাচীনত্ব ৭০০০ খ্রিস্টপূর্ব বা তারও আগে নির্দিষ্ট হয়েছে। সুতরাং, বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলা যায়, মিশরে বা সুমেরে নয়। টানা ৪০০০ বছর ধরে মেহেরগড় সভ্যতা নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। হরপ্পা সভ্যতার প্রায় ৪ হাজার বছর আগে এর আর্বিভাব। আজ থেকে প্রায় নয় হাজার বছর আগে এটি সৃষ্টি হয়।

মেহেরগড় সভ্যতা, মেহেরগড় সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করো

ভারতের প্রাচীনতম গ্রামীণ সভ্যতা হল নব্য প্রস্তর যুগের মেহেরগড় সভ্যতা। আধুনিক ধারণায় হরপ্পা সভ্যতা ছিল মেহেরগড় সভ্যতারই বিকশিত রূপ। এ প্রসঙ্গে শিরিন রত্নাগর বলেছেন, “মেহেরগড়ই হরপ্পা সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের স্তরগুলি তুলে ধরে।

মেহেরগড় সভ্যতার পরিচয়

[1] আবিস্কার: ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ যা ফ্রঁসোয়া জারিজ (Jean Francois Jarrige) পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান রিচার্ড মিডাে (Richard Medow)-কে সঙ্গে নিয়ে বালুচিস্তান ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে খননকার্য চালান। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে কাচ্চি সমভূমি (বালুচিস্তানের পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকায়)- তে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে মেহেরগড় সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।

[2] অবস্থান: পাকিস্তানের বালুচিস্তানের কাচ্চি জেলার‌বােলান গিরিপথের ধারে মেহেরগড় প্রত্নক্ষেত্রের (প্রায় ৫০০ একর জুড়ে) অবস্থান। মেহেরগড় সভ্যতার উত্তরে বােলান গিরিপথ, কাকর পর্বতশ্রেণি, লােরলাই-ঝােব নদী, দক্ষিণে কাচ্চি সমভূমি, সিন্ধুনদ, কিরথর পর্বতশ্রেণি, পূর্বে সুলেমান পর্বতশ্রেণি, সিন্ধু উপত্যকা এবং পশ্চিমে রয়েছে হেলমান্দ, মারগাে ও তাহলাব মরুভূমি।

[3] প্রত্নকন্দ্র: মেহেরগড় ছিল একটি গ্রামীণ সভ্যতা। মেহেরগড় সভ্যতার উল্লেখযােগ্য কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্র বা প্রত্নকেন্দ্র ছিল—নৌসেরা, রানা ঘুনডাই, পেরিয়ানো ঘুনডাই, কিলিগুল মহম্মদ, কাচ্চিবেগ, কুল্লি, দারারকোট, মুন্ডিগাক, কোটদিজি প্রভৃতি।

[4] কালসীমা: জাঁ ফ্রাসােয়া জারিজ মেহেরগড় সভ্যতার সময়ের ব্যাপ্তিকে তিন পর্বে ভাগ করলেও আসকো পারপােলা আটপর্বের যে কালসীমা নির্ণয় করেছেন তা হল—

  • প্রথম পর্ব: আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • দ্বিতীয় পর্ব: আনুমানিক ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • তৃতীয় পর্ব: আনুমানিক ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • চতুর্থ-পঞ্চম পর্ব: আনুমানিক ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • ষষ্ঠ-সপ্তম পর্ব: আনুমানিক ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • অষ্টম পর্ব: আনুমানিক ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

[5] বৈশিষ্ট্য: মেহেরগড় সভ্যতার অন্যতম দুটি বৈশিষ্ট্য হল—

  • নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা: ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা ঘটে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে। ৭টি পর্যায়বিশিষ্ট মেহেরগড় সভ্যতার সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ পর্যন্ত। তাই পণ্ডিতগণ সাধারণভাবে মেহেরগড় সভ্যতাকে নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা বলে থাকেন।
  • প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা: যে প্রাচীন সভ্যতার কোনাে লিখিত বিবরণ নেই, শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে যে সভ্যতার পরিচয় জানা যায়, সেই সভ্যতাকে বলে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা। মেহেরগড়ে বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির ভিত্তিতেই কেবল সভ্যতাটির বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়। তাই মেহেরগড় সভ্যতাকে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা বলা হয়।

[6] ঘরবাড়ি: মেহেরগড়ে কৃষিভিত্তিক জীবনধারার বিকাশ ঘটলে স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠে। রােদে শুকানাে কাদামাটির ইট দিয়ে বাড়ি তৈরি শুরু হয়। বাড়িগুলি ছােটোবড়াে কয়েকটি কামরায় বিভক্ত ছিল। বাড়িগুলিতে আগুন জ্বালিয়ে ঘর গরমের ব্যবস্থা ছিল।

[7] শিল্প: মেহেরগড়বাসী মৃৎশিল্প, অলংকারশিল্প, বয়নশিল্পে পারদর্শী ছিল। পােড়ামাটির নারীমূর্তি তৈরির পাশাপাশি তারা তামার পুঁতি, আংটি, ছুরি প্রভৃতি তৈরি করতে শিখেছিল| তারা বৈদূর্যমণি, নীলকান্তমণি, মাদার অফ পার্ল দিয়ে হার তৈরির কৌশল শিখেছিল। এ ছাড়াও তারা পশুর লোম ও উল দিয়ে কাপড় বুনতে শিখেছিল।

[8] জীবিকা: মেহেরগড়বাসীর জীবিকা ছিল পশুপালন, শিকার, কৃষিকাজ ও ব্যাবসাবাণিজ্য। তারা মূলত কৃষিকাজের সুবিধার জন্যই প্রথমদিকে পশুপালন শুরু করেছিল। তাদের উৎপাদিত কৃষিজ ফসল ছিল—যব, গম, তুলো, খেজুর প্রভৃতি।

[9] সমাধিপ্রথা: মেহেরগড়ে মৃতদেহকে সমাধিস্থ করার প্রথা প্রচলিত ছিল। সমাধির আগে মৃতদেহে গেরুয়া মাটি মাখানো হত। সমাধিস্থলে মৃতদেহের পাশে মূল্যবান অলংকার-সহ তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখা হত, যেমন—পাথর বা ঝিনুকের মালা, হাড়ের আংটি, বৈদূর্যমণি (বা লাপিস লাজুলি), নীলকান্তমণি (বা টার্কোয়াজ) প্রভৃতি।

মেহেরগড় সভ্যতা কোন যুগের সভ্যতা

মেহেরগড় একটি নব্যপ্রস্তরযুগীয় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যার সময়কাল ৭,০০০ – ২৫০০/২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও ক্যাথরিন জারিজ পরিচালিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দল ১৯৭৪ সালে এই স্থানটি আবিষ্কার করেন এবং ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে এর খননকাজ চালিয়ে যান।

এখন পর্যন্ত মোট ছয়টি টিলা থেকে প্রায় ৩২,০০০ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে। মেহেরগড়ের মোট ক্ষেত্রফল ৪৯৫ একর (২ বর্গকিলোমিটার), এখানকার প্রথম বসতি ছিল এর উত্তর-পূর্ব কোণের একটি ছোট্ট কৃষিনির্ভর গ্রাম, যার সময়কাল ৭,০০০ থেকে ৫,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি।

মেহেরগড় সভ্যতা কোন নদীর তীরে অবস্থিত

মেহেরগড় সভ্যতা বোলান নদীর তীরে কোয়েটা শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে মেহেরগড়ের সভ্যতা অবস্থিত।

  • পরীক্ষার দ্বারা জানা গেছে যে, মেহেরগড় সভ্যতা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ পর্যন্ত টিকেছিল।
  • ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জা ফ্রাঁসোয়া জারিজ পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান রিচার্ড মিডো-এর সঙ্গে বালুচিস্তান ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে খননকার্য চালান। এর ফলে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বালুচিস্তানের পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকার কাচ্চি সমভূমিতে মেহেরগড় সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।
  • মেহেরগড় সভ্যতায় নব্য প্রস্তর যুগের বিভিন্ন হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়। কৃষি যন্ত্রপাতির মধ্যে প্রাচীনতম হাতিয়ারটি হল বিটুমেন জাতীয় পাথর খণ্ডে নির্মিত কাস্তে পাথর। হাতিয়ার সহ অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে অন্যতম ছিল কাস্তে, মৃৎপাত্র, শিলনোড়া, যাঁতা, হামানদিস্তা, নিড়ানি, বিভিন্ন ধরনের পাথরের ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি প্রভৃতি। তবে পাথর ছাড়াও এই সময়ের হাড়ের হাতিয়ারও এখানে আবিষ্কৃত হয়।

মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য

মেহেরগড় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল কয়েকটি পর্যায়ে। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে সাতটি পর্যায়ে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটে। পণ্ডিতগণ মনে করেন, মেহেরগড় সভ্যতার রূপ পরিবর্তিত হয়ে মিশে যায় মহেঞ্জোদারো এবং লোথাল সভ্যতার সঙ্গে। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের দেওয়া পর্যায় কালসীমা এক নয়।

  • মেহেরগড়ের প্রথম পর্যায় আনুমানিক ৭০০০ থেকে ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • দ্বিতীয় পর্যায় ৫০০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • তৃতীয় পর্যায় ৪৩০০ থেকে ৩৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
  • তার পরবর্তী পর্যায়গুলি ৩২০০ থেকে আনুমানিক ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে।

(ক) প্রাচীনতর পর্যায়ে একাধিক ঘর নিয়ে বাড়ি তৈরি করা হত । এইসব বাড়ি তৈরি হত রোদে শুকানো ইটের সাহায্যে ।

(খ) এই সময় তারা চাষবাস, পশুপালন ও শিকার করত । পরের দিকে কৃষিকার্য ও পশুপালনের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়া।

(গ) এই সময় তারা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার করতে শুরু করেছিল । বাড়িগুলিও আকারে বড়ো হয়েছিল । এইসব বাড়ি থেকে ছোটো শিলনোড়ার পাথর, উনুন, হাড় দিয়ে তৈরি হাতিয়ার ইত্যাদি জিনিস পাওয়া গেছে । সমাধির মধ্যে যে সব জিনিস পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ঝিনুকের তৈরি লকেট, পুঁতি ও ঝিনুক জাতীয় জিনিসের মালা, পাথরের লকেট, হাড়ের আংটি, পালিশ করা পাথরের কুডুল ইত্যাদি প্রধান । তখনকার মানুষ যব, গম, কুল, খেজুর ইত্যাদি চাষ করত । জন্তুজানোয়ারের মধ্যে হরিণ, হাতি, নীলগাই, বুনো ভেড়া ও ছাগল, শুয়োর, গোরু ইত্যাদির হাড় পাওয়া গেছে।

মেহেরগড় সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন

মেহেরগড় সভ্যতায় প্রথমদিকে শিকার ও পশুপালন মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল। পরবর্তীকালে এখানে কৃষিকাজের বিকাশ ঘটে। এ ছাড়া এখানে বিভিন্ন শিল্প এবং বাণিজ্যেরও বিকাশ ঘটেছিল বলে জানা যায়।

মেহেরগড় সভ্যতা কোন কোন কৃষি পণ্য উৎপাদিত হত

1. কৃষি: ভারতে প্রথম কৃষি ও পশুপালন অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল মেহেরগড় সভ্যতাতেই। এখানে গম ও ঘব চাষের প্রমাণ মিলেছে। জলধারার বিভিন্ন স্থানে ছোটো ছোটো বাঁধ নির্মাণ করে এখানকার মানুষ কৃষিজমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করত। এর ফলে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। উদ্বৃত্ত শস্য সংরক্ষণ করার জন্য এখানে শস্যাগারও তৈরি করা হত। প্রধানত অধিবাসীদের নিজেদের ভোগের উদ্দেশ্যেই কৃষি-উৎপাদন করা হত। এই সভ্যতার তৃতীয় পর্যায়ে কৃষির ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। নব্য প্রস্তর যুগে কৃষি পদ্ধতির আবিষ্কার ও অগ্রগতির বিষয়টিকে পুরাতত্ত্ববিদ গর্ডন চাইল্ড ‘নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব‘ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

2. পশুপালন: মেহেরগড় সভ্যতায় কৃষির প্রয়োজনে পশুপালনের গুরুত্ব বেড়েছিল। তা ছাড়া খাদ্য হিসেবে মাংসের প্রয়োজনেও পশুপালন করা হত। অবশ্য কৃষি ও পশুপালনের পাশাপাশি খাদ্যের প্রয়োজনে শিকার করার পেশা তখনও প্রচলিত ছিল। তবে শিকার করা বন্যপশুর তুলনায় গৃহপালিত পশুর মাংস পরবর্তীকালের মানুষ বেশি খেত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমদিকে ছাগল, কুঁজওয়ালা ষাঁড়, ভেড়া প্রভৃতি পশুকে তারা পোষ মানিয়েছিল। পরে মোষ ও অন্যান্য পশুকে পোষ মানিয়ে পালন করা শুরু হয়।

3. মৃৎশিল্প: মেহেরগড় সভ্যতায় মৃৎশিল্পেরও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। 

(1) প্রথমদিকে মৃৎপাত্রগুলি হাতে করা হত। 

(2) পরবর্তীকালে পশ্চিম এশিয়া থেকে ঘুরন্ত চাকার সাহায্যে মৃৎপাত্র তৈরির কৌশলটি মেহেরগড় সভ্যতায় আমদানি করা হয়। ফলে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ নাগাদ মেহেরগড় সভ্যতায় মৃৎপাত্র তৈরিতে ঘুরন্ত চাকার ব্যবহার শুরু হয়। 

(3) পরবর্তীকালে মৃৎপাত্রগুলি চুল্লির আগুনে পোড়ানো এবং তাতে বিভিন্ন রঙের প্রলেপ দেওয়া শুরু হলে মৃৎশিল্পে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। দৈনন্দিন ব্যবহার্য পাত্র ছাড়াও এই সভ্যতায় পোড়া মাটির নারীমূর্তি, গবাদিপশুর মূর্তি প্রভৃতি তৈরি হত বলে নিদর্শনগুলি থেকে অনুমান করা যায়।

4. বয়নশিল্প: মেহেরগড় সভ্যতায় বয়নশিল্পের বিকাশ ঘটেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে কার্পাস তুলোর প্রচুর পোড়া বীজ পাওয়া গেছে। এটি ভারতে কার্পাস তুলো চাষের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে মনে করা হয়। অনুমান করা যেতে পারে যে, কার্পাসের তুলো দিয়ে সুতো তৈরি করে তা কাপড় বোনার কাজে ব্যবহার করা হত। এখানে হাতে সেলাই করা বিভিন্ন বস্ত্রাদি ব্যবহারের নিদর্শনও আবিষ্কৃত হয়েছে।

5. অন্যান্য শিল্প: মেহেরগড় সভ্যতায় অন্যান্য বিভিন্ন শিল্প ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল অলংকার শিল্প। অলংকারগুলি তৈরি হত পাথর দিয়ে। এখানে ছোটো শঙ্খ, নীলকান্তমণি, চুনি, লাপিস লাজুলি প্রভৃতির যথেষ্ট ব্যবহার ছিল। মেহেরগড় সভ্যতায় নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী ও গৃহস্থালির টুকিটাকি আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনে বাসিন্দারা এগুলি ব্যবহার করত। এখানে নলখাগড়ার তৈরি ঝুড়ি, পশুর লোমের বস্ত্র প্রভৃতিরও নিদর্শন মিলেছে। এ ছাড়া ঘর গরম রাখার চুল্লি, গোলাঘর, সিল, স্বস্তিকা চিহ্ন প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে।

6. বাণিজ্য: মেহেরগড় সভ্যতার তৃতীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত তামার সিলমোহর থেকে অনুমান করা হয় যে, এই সভ্যতার মানুষ ব্যাবসাবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ড. রণবীর চক্রবর্তী এই অভিমত সমর্থন করেন। তামার সিলমোহরের দ্বারা বণিকরা নিজেদের পণ্য চিহ্নিতকরণের কাজ করত। বণিকরা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের বাণিজ্যের সঙ্গেই যুক্ত ছিল বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। বাণিজ্য পণ্যের অন্যতম ছিল উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য।

আরো পড়তে: হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা, হরপ্পা সভ্যতার প্রশ্ন উত্তর

মেহেরগড় সভ্যতা ও হরপ্পা সভ্যতার পার্থক্য

হরপ্পা সভ্যতামেহেরগড় সভ্যতা
মানুষ বাস করত ছোট গ্রাম এলাকায়।মানুষ শহর ও শহরে বাস করত।
বাড়িগুলি দুর্গের পূর্বে নির্মিত হয়েছিল দুর্গের পূর্বে বাড়িগুলি নির্মিত হয়েছিল।বাড়িগুলি স্বতন্ত্র প্রাসাদ এবং মন্দিরের চারপাশে নির্মিত হয়েছিল।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ।পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
মন্দিরের মতো বিশেষ কোনো উপাসনালয় পাওয়া যায়নি।পূজার জন্য মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল।
ব্যবসায়ীদের দ্বারা শাসিত।একজন পুরোহিত-রাজা দ্বারা শাসিত।
উদ্ভাবিত পরিমাপ ও ওজন পদ্ধতি।প্রথম চাকা আবিষ্কার করেন।
গয়না, তুলা, শিল্প এবং পুঁতির মতো জিনিসগুলির জন্য ব্যবসাটি ঘটেছে।মূল্যবান পাথরের ব্যবসা।
মেহেরগড় সভ্যতা ও হরপ্পা সভ্যতার পার্থক্য

মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব

মেহেরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এখানে প্রাপ্ত নিদর্শন প্রমাণ করে আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে একটানা প্রায় ৪৫০০ বছর এখানে মনুষ্যবসতি ছিল।’ দু-হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে মেহেরগড় সভ্যতা পশুচারণে এবং যব ও গম উৎপাদনে সক্ষম হয়ে উঠেছিল।

চার হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে কুমোরের চাকা ব্যবহার করতে শিখেছিল। বেলুচিস্তানের ‘নল সভ্যতা’ এবং ‘কুল্লি সভ্যতা’ মেহেরগড় সভ্যতারই অঙ্গ। রোমিলা থাপার মনে করেন যে, এই সভ্যতার কিছু কেন্দ্র কৃষি-মেষপালক থেকে খামার এবং তারপর নগর পত্তনের দিকে এগিয়ে গিয়ে হরপ্পার নগরীয় সভ্যতার অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছিল।

মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসের কারণ

মেহেরগড় সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ লক্ষ করা যায় এখানকার চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায়ে। গ্রামীণ মেহেরগড় সভ্যতা এই সময় ক্রমে নগরজীবনের দিকে যেতে থাকে যা পরবর্তীকালে বালুচিস্তানের সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতায় চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়। অধ্যাপক ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ড. দিলীপ চক্রবর্তী, ড. শিরিন রত্নাগর প্রমুখ ঐতিহাসিক পরবর্তীকালের সিন্ধু সভ্যতাকে পূর্ববর্তী মেহেরগড় সভ্যতার উত্তরসূরি বলে মনে করেন। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেন যে, মেহেরগড়ের নগরায়ণ পরবর্তী সিন্ধু সভ্যতায় পরিণত রূপ লাভ করেছিল। যাই হোক, দীর্ঘ অস্তিত্বের পর আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে ভারতের প্রাচীনতম এই মেহেরগড় সভ্যতার অবসান ঘটে।

আরো অন্যান্য প্রশ্নোত্তরের সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | মেহেরগড়

Q1. মেহেরগড় সভ্যতা কাকে বলে

Ans – ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত পাকিস্তানে বেলুচিস্তানের অন্তর্গত মেহেরগড় হল বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলাের অন্যতম। ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জেন ফ্রাঁসােয়া জারেজ এবং রিচার্ড মিডাে মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন।

১) পাকিস্তানের কোয়েটা শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলােমিটার দূরে বােলান গিরিপথের কাছে অবস্থিত মেহেরগড় সভ্যতার মূল কেন্দ্রগুলি ছিল : কিলে গুল মহম্মদ, টদিজি, গুমলা মুন্ডিগাক, রাণা ঘুনডাই, আনজিরা ও মেহেরগড়।

২) আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, বেলুচিস্থানের জোব নদী থেকে পশ্চিম ভারতের সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল জুড়ে মেহেরগড় সভ্যতা বিস্তৃত ছিল।

প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক ডক্টর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়ের মতে, হরপ্পা সভ্যতার অনেক আগেই মেহেরগড়কে কেন্দ্র করে ভারতীয় উপমহাদেশে একটি কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতার সূচনা হয়।

(৪) গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে যে, সাতটি পর্বে মেহেরগড় সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছিল। এই সভ্যতার পর্বের সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৯০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সাল অবধি পরিব্যাপ্ত ছিল এবং তৃতীয় পর্ব থেকে সভ্যতার গড়ন সুবিন্যস্ত হয়।

Q2. মেহেরগড় সভ্যতার সময়কাল

Ans – মেহেরগর সভ্যতা ভারতের নতুন প্রস্তর যুগের সমসাময়িক যুগের সভ্যতার নিদর্শন।

Q3. মেহেরগড় সভ্যতা বর্তমানে কোথায় অবস্থিত

Ans – বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মধ্যবর্তী স্থানে — অর্থাৎ বোলান গিরিপথের কাছে ও কোয়েটা শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে মেহেরগড় সভ্যতার অবস্থান ছিল।

Q4. মেহেরগড় সভ্যতার বাড়ি গুলি কেমন ছিল

Ans – এখানকার অধিকাংশ ঘরবাড়ি ছিল চার কামরাবিশিষ্ট কাদামাটির তৈরি। রােদে শুকানাে কাঁচা ইটের বাড়ি। 

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।