বিপর্যয় কাকে বলে, পরিবেশ বিপর্যয় কাকে বলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাকে বলে

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

বিপর্যয় কী, বিপর্যয় কি

বিপর্যয় বা ডিজাস্টার (Disaster) হল ভূপৃষ্ঠে বা ভূঅভ্যন্তরে সৃষ্ট কোনো বিরাট আকস্মিক ঘটনার ব্যাপক বহিঃপ্রকাশ। বিপর্যয়ের প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। সাধারণত দুর্যোগের পরবর্তী অবস্থা হল বিপর্যয়। তবে সব দুর্যোগের ফলে বিপর্যয় নাও ঘটতে পারে। বিপর্যয় একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যা উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর। এর ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। মানুষ সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হয়।

বিপর্যয় হল দুর্যোগের চরম ফল বা পরিণতি। ‘বিপর্যয়’ বা Disaster শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ ‘Desastre’ থেকে। যেখানে Des অংশের অর্থ Bad বা Evil বা মন্দ এবং Astre অংশের অর্থ star বা তারা। অর্থাৎ এককথায় বিপর্যয় বা Disaster হল মন্দ তারা (Bad Star) বা শয়তান তারা (Evil Star)। অতীতে মানুষ বিশ্বাস করত যে শয়তান তারার প্রভাবেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে।

প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট যে-কোনাে তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদি ঘটনা, যখন জীবন হানি ও সম্পদ হানি ঘটায় এবং বাইরের বা অপরের সাহায্য ছাড়া যার মােকাবিলা করা সম্ভব হয় না তাকেই বলে বিপর্যয় (Disaster)। বিপর্যয়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন সম্পদহানি ও প্রাণহানি ঘটে অপরদিকে পরিবেশের গুণগত মানও হ্রাস পায়।

কলােরাডাে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের গবেষকদের প্রদত্ত বিপর্যয়ের সংজ্ঞা হল—এক মিলিয়ন ডলার ক্ষতি এবং একশাে (100) এর বেশি জীবনহানি হবে আর 100 এর বেশি মানুষ আহত হবে, এমন ঘটনা হল বিপর্যয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ভাষায় বিপর্যয় হল—এমন যে-কোনাে ঘটনা যার জন্য অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি মানুষের মৃত্যু এবং স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। উদাহরণ—2004 খ্রিস্টাব্দে যে সুনামি ঘটেছিল তার ফলে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা সহ ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী অন্যান্য দেশের প্রায় 3,00,000 লােকের মৃত্যু হয়েছিল।

বিপর্যয় কাকে বলে

প্রাকৃতিক বা মানবীয় কারণে সৃষ্ট যে সব পরিবেশগত চূড়ান্ত ঘটনা অতি দ্রুত মুহূর্তের মধ্যে সংঘটিত হয়ে বাছবিচারহীন ভাবে উদ্ভিদ, মানুষ ও জীবজন্তুর প্রাণ ও সম্পত্তিহানি এবং পরিবেশগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটলে তাদের বিপর্যয় বলে। অন্যভাবে বলা যায় – বিপর্যয় হল এমন একটি মারাত্মক ক্ষতিকর প্রাকৃতিক ও মানবিক ঘটনা যা মানুষের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ ও জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করে, এবং তা প্রাকৃতিক কারণে ঘটলে তাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলা হয়।

বিপর্যয়ের সংজ্ঞা

  1. ভূগোলবিদ সাবিন্দ্র সিং: -এর মতে, “বিপর্যয় হল আকস্মিক প্রতিকূল অথবা দুর্ভাগ্যজনক চরম ঘটনা, যা মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীর ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়।
  2. বিশ্ব স্বাস্থ্য প্রদত্ত সংজ্ঞা: বিপর্যয় হল এমন এক ধরণের ঘটনা যার দ্বারা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, মানুষের মৃত্যু ও স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে এবং যেখানে অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে যথাযথভাবে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিষেবা দিতে হয়।
  3. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক: তাঁদের মতে, এক মিলিয়ন ডলার নষ্ট হবে এবং একশোর বেশি জীবনহানি ঘটবে আর একশোর বেশি মানুষ আহত হবে এমন ক্ষয়ক্ষতির ঘটনাকে বিপর্যয় বলা হয়।
  4. ওয়েবস্টার প্রদত্ত সংজ্ঞা: ওয়েবস্টার-এর মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কোনো মানব বসতি অঞ্চল যদি শ্মশানে পরিণত হয়, তখন তাকে বিপর্যয় বলে।

বিপর্যয়ের বৈশিষ্ট্য

  • বিপর্যয় কখনও ধীরগতিতে আবার কখনও আকস্মিকভাবে উপস্থাপিত হয়।
  • এর ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার গুরুতর ব্যাঘাত ঘটে।
  • এই ঘটনা মানুষের জীবনযাত্রা ও সম্পদের ক্ষতি সাধন করে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও আঘাত হেনে জীবনধারণের কঠোর অবস্থা তৈরি করে।
  • এটি বৃহৎ স্কেলে সংঘটিত হয়।
  • বিপর্যয় প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই সংঘটিত হতে পারে।
  • সামাজিক পরিকাঠামাে যেমন রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, আস- বাবপত্র প্রভৃতি বিপর্যয়ের কবলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
  • এর ফলে পরিবেশের গুণগত মানের চরম অবক্ষয় ঘটে, যার কুপ্রভাব দীর্ঘ সময় ধরে পরিবেশে বজায় থাকে।

পরিবেশ বিপর্যয় কাকে বলে

যে সকল দুর্ঘটনা প্রাকৃতিকভাবে ঘটে এবং প্রকৃতি ও সভ্যতার সমূহ ক্ষতি ঘটায় তাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে।

ইংরেজী Ecology হল পরিবেশ যা গ্রীক শব্দ oikos এবং logos এর সমন্বিত রুপ। oikos এর অর্থ হল
ঘর,বসতি,বাসস্থান এবং logos এর অর্থ হল জ্ঞান ও গবেষণা। কাজেই পরিবেশ সম্পর্কিত জ্ঞান হল পরিবেশ বিজ্ঞান।

১৮৮৫সালে বিজ্ঞানী রিটার সর্বপ্রথম এই পরিবেশ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

  • বিজ্ঞানী আর্নষ্ট হেজেল বলেন, “জীবন্ত সৃষ্ট জগতের পারস্পারিক সম্পর্ক তথা তারা যে আবেষ্টনীয় জগতের মধ্যে বসবাস করে সেই সম্পর্কিত জ্ঞান হল পরিবেশ বিজ্ঞান।” অর্থাৎ, বসবাস সংক্রান্ত জ্ঞান হল পরিবেশ।
  • ড. সাঈদ মুহাম্মদ আল-হাফফার বলেন, “পরিবেশ হল প্রকৃতির ও সামাজিক ব্যবস্থাসমূহের সমন্বিতরুপ যেখানে মানুষ ও অন্যান্য জীব ধারন,বর্ধন, ক্রিয়া সুন্দরভাবে পরিচালনা করে।
  • গোপালনাথ খান্না বলেন, “Environment as the sum of total effects the development and life of organism. ” মোটকথা পৃথিবীর সবকিছু যা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বায়ুবণ্ডলের ওজোন স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত যাওথা আল, বাতাস, পানি, মেঘ, কুয়াশা, মাটি, বন, শব্দ, পাহাড়- পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর,মানবনির্মিত সর্বপ্রকারের অবকাঠামো এবং গোটা উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের সমন্বয়ে যা সৃষ্ট তা হল পরিবেশ।

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ

পরিবেশগত বিপর্যয় বাস্তুতন্ত্রের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই বিপর্যয়গুলি প্রায়শই স্বল্প সময়ের হয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত আবাসস্থলে বসবাসকারী প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

মাঝে মাঝে পরিবেশগত বিপর্যয় ভৌত পরিবেশকে এতটাই বদলে দেয় যে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি অপরিবর্তনীয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে, পরিবেশগত ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে এবং আবাসস্থল পুনর্বাসন করা যেতে পারে।

পরিবেশগত বিপর্যয় দুটি সাধারণ বিভাগে পড়ে। কিছু দুর্যোগ প্রাকৃতিক জলবায়ু বা আবহাওয়ার কারণে ঘটে। এর মধ্যে রয়েছে দাবানল, ভূমিধস, বন্যা, ভূমিকম্প, খরা, টর্নেডো, সুনামি এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। যদিও এই প্রাকৃতিক পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণগুলির সাথে মানুষের ক্রিয়াকলাপ জড়িত না, কিছু ক্ষেত্রে মানুষের প্রভাবের কারণে প্রভাবগুলি আরও খারাপ হয়।

উদাহরণস্বরূপ, 2004 সালের ভারত মহাসাগরের সুনামির সময় যে পরিবেশগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল সেগুলি ছিল যেখানে নগর উন্নয়ন এবং নির্মাণ প্রবাল প্রাচীরগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। যেসব জায়গায় প্রবাল প্রাচীরগুলি স্বাস্থ্যকর ছিল, সেখানে প্রাচীরটি একটি বাফারের মতো কাজ করে, দৈত্য তরঙ্গের শক্তিকে বিচ্যুত করে।

পরিবেশগত বিপর্যয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে মানুষের কার্যকলাপের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ। মানব-প্ররোচিত পরিবেশগত বিপর্যয়ের উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে তেলের ছিটা, রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়া এবং পারমাণবিক ঘটনা।

উপরন্তু, যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বাস্তুতন্ত্রের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট বিপর্যয়ের চেয়ে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় পরিবেশের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

উদাহরণস্বরূপ, 1989 সালে প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে এক্সন ভালদেজ সুপারট্যাঙ্কারটি ছুটে যাওয়ার সময় যে বিশাল তেল ছড়িয়ে পড়েছিল তার বড় পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। তেল ছড়িয়ে পড়ার বারো বছর পরে, তেলের উল্লেখযোগ্য আমানত, যা অনেক প্রজাতির জন্য বিষাক্ত, ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় টিকে থাকে। 2002 সালে, অন্তত আট প্রজাতির মাছ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর জনসংখ্যার আকার এখনও তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।

যদিও পরিবেশগত বিপর্যয়গুলি বাস্তুতন্ত্রের উপর একটি ভয়ানক টোল নেয়, তবে তারা হুমকির সম্মুখীন আবাসস্থলগুলির প্রতি মনোযোগ বাড়াতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, সরকারি, আন্তঃসরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির দ্বারা বর্ধিত তদারকির ফলে আইন প্রণয়ন হয়, যা ভবিষ্যতের পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রভাবকে হ্রাস করে।

উদাহরণস্বরূপ, এক্সন ভালদেজ তেল ছড়িয়ে পড়া তেল শিপিং শিল্পের অনেক শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণের দিকে পরিচালিত করে। এছাড়াও, তেল ছড়িয়ে পড়া পরিষ্কার করার জন্য অতিরিক্ত তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছিল, যদি সেগুলি আবার ঘটে থাকে। 2004 সালের সুনামির পরিপ্রেক্ষিতে, জাতিসংঘ একটি ভারত মহাসাগরীয় সুনামি সতর্কীকরণ ব্যবস্থা সংগঠিত করতে শুরু করে যাতে নাগরিকদের সতর্ক করা যায় যখন আরেকটি বিশাল ঢেউ তীরে উঠছে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাকে বলে

যে সকল দুর্ঘটনা প্রাকৃতিকভাবে ঘটে এবং প্রকৃতি ও সভ্যতার সমূহ ক্ষতি ঘটায় তাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উৎপত্তিতে মানুষের কোনাে ভূমিকা থাকে না। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক শক্তি এর উৎপত্তির প্রধান কারণ। তবে প্রতিটি বিপর্যয়ের সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উৎপত্তিগত কারণগুলি হল 一

(১) জলবায়ু সংক্রান্ত : ঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডাে, হ্যারিকেন, সামুদ্রিক জলােচ্ছাস (সুনামি) প্রভৃতি।

(২) ভূতত্ত্ব ও ভূমিরূপ সংক্রান্ত : ভূমিকম্প, ভূমিক্ষয় আগ্নেয়গিরির উদগিরণ, ধস, হিমবাহ ইত্যাদি।

(৩) জল-সংক্লান্ত : বন্যা, খরা, জোয়ার ইত্যাদি।

(৪) দাবানল বা আগুনও ব্যাপকভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হতে পারে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শ্রেণিবিভাগ

প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মূলত প্রধান 2টি ভাগে ভাগ করা যায়- [1] পার্থিব বিপর্যয়। [2] অপার্থিব বিপর্যয়।

পার্থিব বিপর্যয়

ভূমিরূপ গঠনকারী নানান প্রক্রিয়া পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল, ভূপৃষ্ঠ বা ভূ-অভ্যন্তরে অর্থাৎ পৃথিবীতেই সৃষ্ট হয় এবং ক্রিয়াশীল হয় সেই সব প্রক্রিয়াকে পার্থিব প্রক্রিয়া বলে। এই পার্থিব প্রক্রিয়াগুলির প্রভাবে যখন বিপুল পরিমাণে প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটে তখন তাকে পার্থিব বিপর্যয় বলে। এই পার্থিব বিপর্যয়কে আবার 2 টি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল一

  • অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় : পৃথিবীর অভ্যন্তরে সৃষ্ট সংকোচন, প্রসারণ, উত্থান, অবনমন, বিচ্ছেদ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠে যদি বিপর্যয় নেমে আসে তাকে অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় বলে।

অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় আবার ও প্রকার- (i) আগ্নেয়গিরির উদগিরণ বিপর্যয়, (ii) ভূমিকম্প জনিত বিপর্যয়, (iii) ধস জনিত বিপর্যয়।

(i) আগ্নেয়গিরির উদগিরণ বিপর্যয় : আগ্নেয়গিরির উদগিরণের মাধ্যমে যদি ভূপৃষ্ঠে বিপর্যয় নেমে আসে তখন তাকে আগ্নেয়গিরির উদগিরণ বিপর্যয় বলে। যেমন 2006 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে মাউন্ট মেরানি আগ্নেয়গিরির উদগিরণের কারণে বহু মানুষের মৃত্যু হয় ও বহু মানুষ গৃহচ্যুত হয়।

(ii) ভূমিকম্পজনিত বিপর্যয় : ভূমিকম্পজনিত কারণে বিপর্যয় নেমে এলে তাকে ভূমিকম্পজনিত বিপর্যয় বলে। যেমন 2001 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার সিয়াটল শহরে ভূমিকম্পের ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

(iii) ধসজনিত বিপর্যয় : ধসজনিত কারণে বিপর্যয় নেমে এলে তাকে ধসজনিত বিপর্যয় বলে। যেমন সিকিম অঞ্চলে ধসজনিত কারণে মাঝে মধ্যেই বিপর্যয় নেমে আসে।

  • বাহ্যিক বিপর্যয় : পৃথিবীতে বিভিন্ন অস্বাভাবিক ঘটনা ও পরিবেশগত কারণে যে সব বিপর্যয় নেমে আসে তাকে বাহ্যিক বিপর্যয় বলে।

বাহ্যিক বিপর্যয়কে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- (i) অস্বাভাবিক ঘটনাজনিত বিপর্যয়, (ii) ক্ৰমান্বয়িক পরিবেশগত বিপর্যয়।

(i) অস্বাভাবিক ঘটনাজনিত বিপর্যয় : শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত এবং সাইক্লোন ইত্যাদি হল অস্বাভাবিক ঘটনার অন্তর্গত। এদের কারণে বিপর্যয় নেমে এলে তা অস্বাভাবিক ঘটনাজনিত বিপর্যয়রূপে বিবেচিত হয়।

(ii) ক্রমান্বয়িক পরিবেশগত বিপর্যয় : বন্যা, খরা, শীতল ও উয় স্রোতের কারণে কোনাে বিপর্যয় নেমে এলে তাকে ক্রমান্বয়িক পরিবেশগত বিপর্যয় বলে।

অপার্থিব বিপর্যয়

অপার্থিব বিপর্যয় বলতে পার্থিব বিপর্যয় ব্যতীত বা গ্রহ বহিস্ত বিপর্যয়কে বােঝায়। অনেক সময় উল্কা পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে এবং তার ফলে ভূমিকম্প হয়। এ ছাড়া উল্কাতে চাপা পড়েও অনেক ক্ষতি হয়। এগুলি অপার্থিব বিপর্যয় রূপেই পরিচিত।

বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা বলতে কী বোঝো

কোনো বিপর্যয় ঘটার পূর্বেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, সাবধানতা অবলম্বন [মানুষ-সহ বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রাণহানি রোধ এবং সম্পত্তি নষ্টের পরিমাণ কমানো], বিপর্যয় চলাকালীন পরিকল্পিত ব্যবস্থাগ্রহণ এবং বিপর্যয় ঘটার পরে দ্রুত ত্রাণ ও উদ্ধারকার্য পরিচালনা করা এবং বিপর্যয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে বিপর্যয় মোকাবিলাকেই বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা বলা হয় ।

বিপর্যয়কে প্রশমিত করা, সামাল দেওয়া ও তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়াকেই বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা বলা হয়।

বিপর্যয় ব্যবস্থাপনার কৌশল

বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় মূলত তিন ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হয় তাহল –

A. বিপর্যয় ঘটার পূর্বের পরিস্থিতি

কোন বিপর্যয় ঘটলে সেখানে ক্ষয়ক্ষতি কিভাবে কমানো যায়, এই পর্যায়ে যে ধরনের কার্যগুলিকে হাতে নেওয়া হয় যা প্রস্তুতিমূলক কাজকর্ম নামে পরিচিত সেগুলি হল –

1. ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলের মানচিত্র প্রস্তুতকরণ।

2. বিপর্যয় সম্পর্কে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

3. ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসতি করার কাজ সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা।

4. বিপর্যয়ের সময় নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারে তা চিহ্নিত করা।

5. আবহাওয়া সংক্রান্ত নথি সংগ্রহ করা।

6. উপগ্রহের মাধ্যমে, টেলিভিশন, রেডিও প্রভৃতি গণমাধ্যমের সাহায্যে সত্যতা যাচাই করা ইত্যাদি।

B. বিপর্যয় চলাকালীন পরিস্থিতি

বিপর্যয়গ্রস্থ ব্যক্তিদের চাহিদা প্রয়োজন গুলি যাতে ঠিকঠাক করে মিটে তার সুব্যবস্থা করা। এই পর্যায়ে যে ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করা হয় তা হলো –

1. বিপদগ্রস্ত বা আটকে পড়া মানুষজনদের দ্রুত উদ্ধার করা।

2. প্রাথমিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা।

3. দ্রুত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া।

4. বিপদগ্রস্থ মানুষজনদের নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে যাওয়া।

C. বিপর্যয়ের পরবর্তী পরিস্থিতি

দ্রুত বিপর্যয়গ্রস্থ অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার যাতে আগের মতো বিপদে আবার পড়তে না হয় তার ব্যবস্থা করা। এই পর্যায়ে যে ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করা হয় তাহল –

1. বিপদগ্রস্ত আটকে পড়া মানুষজনকে উদ্ধার করা

2. যথেচ্ছ পরিমাণে ত্রাণ শিবির গড়ে তোলা।

3. প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা শিবিরের আয়োজন করা।

4. নিখজ মানুষের তালিকা প্রস্তুত করা।

5. আশ্রয়হারা মানুষের আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যাওয়া।

6. অকেজো হয়ে যাওয়া রাস্তা, সেতু, টেলিফোন, বিদ্যুতের তার প্রভৃতি মেরামত করা।

7. বিপদগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন করা।

মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয় কাকে বলে

মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়কে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলোর মধ্যে আবার প্রত্যক্ষ ভাবে সৃষ্ট এবং পরোক্ষ ভাবে সৃষ্ট বিপর্যয় দৃশ্যমান হয়। প্রত্যক্ষভাবে সৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে দেশে দেশে যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ, পারমাণবিক যুদ্ধ ইত্যাদির পর দেশের সামাজিক দুর্বলতা ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পন্ন পরিস্থিতি বিদ্যমান এবং পরোক্ষ ভাবে সৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে দেহে সংক্রমিত ভাইরাসজনিত রোগে মৃত্যু।

মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয় এর উদাহরণ

মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে দেশ তথা সারা বিশ্ব এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। মনুষ্যবল নষ্ট, বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে অসুস্থতা ইত্যাদির সাথে সাথে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে:-

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের দেশগুলোর ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পর অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল এবং অনেকেই সংক্রমিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন প্রাণি থেকে সংক্রমিত ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্ব সন্ত্রস্ত। যে-কোন সংক্রামক রোগ যা দ্রুতগতিতে মনুষ্য দেহে ছড়িয়ে পড়ে সেটাই মহামারী।
  • গত একশ বছরে সারা বিশ্বে ভাইরাসঘটিত সাতটি মহামারী আঘাত হেনেছে। বর্তমানে এর সঙ্গে আরও একটি মহামারীর আকার ধারণ করে মনুষ্য-জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। অতীতের ভাইরাসজনিত ‘গুটি’ (১৯০০), ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ (১৯১৮-১৯১৯), ‘এশিয়ান ফ্লু’ (১৯৫৬), ‘এইডস’ (১৯৮১), ‘সার্স’ (২০০৩), ‘সোয়াইন ফ্লু’ (২০০৯), ‘ইবোলা’ (২০১৪) রোগগুলো বিশ্বের এক এক প্রান্তে মহামারীর আকার ধারণ করে বিভিন্ন দেশে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। এসব ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগে বহু লোকের মৃত্যু ঘটেছিল।
    • ১৯০০ সালে গুটিতে উত্তর আমেরিকায় প্রায় ৫৬ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।
    • ১৯১৮- ১৯১৯ সালে ইউরোপের শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ‘স্প্যানিশ ফ্লু’তে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল এবং প্রায় ৫০-১০০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।
    • ১৯৫৬ সালে সংক্রমিত ‘এশিয়ান ফ্লু’ নামে এক ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রথমে চীনে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় ১ মিলিয়ন লোক মারা যায়।
    • ১৯৮১ সালে আবিষ্কৃত হওয়া এইডস রোগে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত। ২০১৭ সালেই এই রোগে প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু ঘটে।
    • ২০০৩ সালে চীনে ছড়িয়ে পড়া ‘সার্স ভাইরাসে’ প্রায় ৮০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
    • শূকর থেকে মানবদেহে সংক্রমিত সোয়াইন ফ্লু রোগটি ২০০৯ সালে আমেরিকা ও মেক্সিকোতে মহামারীর রূপ নেয় এবং প্রায় ১৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটায়।
    • ইবোলা নামে ভাইরাসটি ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় দেখা দিয়েছিল এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়।

আরো পড়তে: হড়পা বান কি, হড়পা বান কাকে বলে, হড়পা বান কেন হয়

দুর্যোগ ও বিপর্যয় পার্থক্য

প্রকৃতি ও মনুষ্য সৃষ্ট যে ঘটনা গুলো মানুষের প্রাণহানী ঘটায়, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কে ব্যাহত করে, প্রাকৃতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সম্পদের ক্ষতি করে সেই ঘটনা গুলোকে তাদের তীব্রতা, ক্ষয় ক্ষতির মাত্রা অনুসারে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা হয়, যথা – দুর্যোগ ও বিপর্যয়। এখানে এই দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের পার্থক্য গুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। 

প্রকৃতিদুর্যোগবিপর্যয়
ধারণা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি যখন হঠাৎ স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ছন্দ পতন ঘটায়, তখন তাকে দুর্যোগ বলে। দুর্যোগের প্রভাবে ব্যাপক আকারে প্রাণহানী, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ ধ্বংস হওয়া কে বিপর্যয় বলে।
নিয়ন্ত্রণ আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিকল্পনার সাহায্যে দূর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।বিপর্যয় কে নিয়ন্ত্রন করা যায় না। উপযুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাহায্যে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায়।
জীবনযাত্রার ওপর প্রভাবদূর্যোগ জীবনযাত্রা কে রুদ্ধ না করলেও অল্প বিস্তর জীবনযাত্রা কে ব্যাহত করে। বিপর্যয় ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা  সম্পূর্ণ ভাবে রুদ্ধ হয়ে যায়।
প্রকৃতিদুর্যোগ ক্ষুদ্র স্কেলে ঘটে থাকে। বিপর্যয় বৃহৎ স্কেলে সংঘটিত হয়।
প্রাণহানীদুর্যোগের ফলে প্রাণহানী প্রায় হয় না বললেই চলে।বিপর্যয়ের ফলে বহুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ হানির সম্ভাবনা থাকে।
ক্ষয়ক্ষতিদুর্যোগের সঙ্গে বৃহদাকার ক্ষয় ক্ষতি যুক্ত থাকে না।কোন স্থানে বিপর্যয় সংঘটিত হলে প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যাপক হারে ক্ষতি হয়। 
উদাহরণ দুর্যোগের উদাহরণ হল ধ্বস, মাঝারি তীব্রতার ভূমিকম্প, খরা, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতি।প্রবল গতিবেগ সম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়, প্রবল তীব্রতার ভূমিকম্প, পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ প্রভৃতি বিপর্যয়ের অন্তর্ভুক্ত।
দুর্যোগ ও বিপর্যয় পার্থক্য
আরো অন্যান্য সরকারি স্কিম সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | বিপর্যয়

Q1. কোন দেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেশ বলে

Ans – চিনকে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেশ বলে।

Q2. রিখটার স্কেল কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় সঙ্গে সম্পর্কিত

Ans – রিখটার স্কেল হল একটি ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপার কাজে ব্যবহার করা হয়।

Q3. চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটেছিল কোথায়

Ans – চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয় 1986 সালে ঘটেছিল।
চেরনোবিল বিপর্যয় ছিল একটি বিপর্যয়কর পারমাণবিক দুর্ঘটনা যা ইউক্রেনের প্রিপিয়াত শহরের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে 26শে এপ্রিল 1986 সালে ঘটেছিল।

Q4. প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেশ কাকে বলে

Ans – 2022 সালের সমীক্ষা অনুসারে, ফিলিপাইনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।