বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | Bankim Chandra Chatterjee

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

সূচিপত্র

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী | Bankim Chandra Chattopadhyay

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও কবি। তাঁর রচিত বিখ্যাত ‘বঙ্কিম রচনাবলী’র মাধ্যমে তিনি লেখার দ্বারা ভিন্ন স্বাতন্ত্র্যতা সৃষ্টি করেছেন।

যে সময়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছিল ঘোর দুর্দিন ,অবহেলা ও অনাদরে যখন বাংলা সাহিত্য নিমজ্জিত প্রায় তখন, পরিত্রাতার মতো যিনি বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষাকে সেই চরম অধঃপতন ও অবমাননার হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন ; তিনি আর কেউ নন- উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, সমাজ সংস্কারক এবং সমগ্র জাতির পথপ্রদর্শক। সারা জীবন তিনি সাহিত্য সাধনা করে গিয়েছেন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন।

আজ সেই মহান ঔপন্যাসিককে নিয়ে আমরা আজ আলোচনা করবো। তার আগে তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

জন্ম ও পরিচিতি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোথায় জন্মগ্রহণ করেন

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২৬ শে জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫ বঙ্গাব্দে , বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটে অবস্থিত কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তাঁর পৈতৃক আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। রামহরি চট্টোপাধ্যায়ের পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। পিতা যাদবচন্দ্র ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর । মাতার নাম দুর্গাসুন্দরী দেবী। বঙ্কিমচন্দ্রের মা তাঁর বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বড় দুই ভাই হলেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বংশপরিচয়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর পিতার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর মায়ের নাম দূর্গাদেবী । বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন তাদের তৃতীয় সন্তান । বঙ্কিমচন্দ্ররা তিন ভাই ছিলেন শ্যামাচরণ , সঞ্জীবচন্দ্র ও পূর্ণচন্দ্র । পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায় ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর শৈশব

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর সাত – আট বছর বয়সেই প্রকৃত শিক্ষা শুরু হয় ।  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর বাবা তখন মেদিনীপুরের ডেপুটি সন ছিলেন । ১৯৪৪ খ্রি : ছয় বৎসর বয়সে সেখানে দাদা সঞ্জীবচন্দ্রের সঙ্গে তাকেও উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় । মিঃ এফ . টিড সাহেব ছিলেন প্রধান শিক্ষক । এখানে বঙ্কিমচন্দ্র অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন । তিনি প্রধান শিক্ষকের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন ।

বঙ্কিমচন্দ্র কোন বছর অকৃতকার্য হতেন না । কয়েকবার বছরে দু’বার প্রমােশনও পেয়েছিলেন । 

বাবার বদলির জন্যও ১৮৪৯ খ্রঃ বঙ্কিমচন্দ্রকে মেদিনীপুর ত্যাগ করে আবার কাঠালপাড়ায় চলে আসতে হল । এখানে পন্ডিত শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শেখেন । মহাভারতের কথা বিশ্লেষণ করে বােঝাতেন পন্ডিত হলধর তর্ক চূড়ামণি ।

সে সময়ই বঙ্কিমের মনে সাহিত্যের বীজ দানা বাঁধতে লাগল । তিনি ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর চুঁচুড়ায় হাজি মহম্মদ মহসীন কলেজে ( হুগলী কলেজ ) বিদ্যালয় বিভাগে ভর্তি হন । সেখানে তিনি জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন ।

লেখকের শিক্ষা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শৈশব বেলা থেকেই পড়াশোনার দিকথেকে প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। তিনি মাত্র একদিনের মধ্যেই বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা কাঁঠালপাড়া গ্রামে শুরু হলেও তা সেখানে সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি কাঁঠালপাড়া গ্রামে আট দশ মাস পড়াশোনা করার পর বাবা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে মেদিনীপুরে চলে আসেন এবং মেদিনীপুরেই তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।

মেদিনীপুরে পাঁচবছর ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করার পর তিনি কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। সেখানে তিনি শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নিতে শুরু করে দেন। তার পর ১৮৪৯ সালে হুগলী মহসিন কলজে ভর্তি হন এবং সেখানে আট বছরে জন্য পড়াশোনা জারি রাখেন। এর পর ১৮৫৬ সালে তিনি আইন পড়ার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৮৫৯ সালে বিএ পরীক্ষা দেন এবং কলেজের প্রথম দুজন গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের চাকুরী ও বৈবাহিক জীবন

পড়াশোনা শেষ করার পরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরকারী চাকরী পেয়েছিলেন এবং বাবার মতো তাঁকেও বাংলার একটি জেলার ডেপুটি কালেক্টর করা হয়। কিছুদিন বাদে তাঁর কর্ম দক্ষতা দেখে ব্রিটিশ সরকার বঙ্কিমচন্দ্রকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত করে। প্রায় তিরিশ বছর তিনি ব্রিটিশদের অধিনে কাজ করেন এবং ১৮৯১ সালে সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই সময় আরো কিছু ঘটনা ঘটে।

যেমন – জীবিকা সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা ছিলেন।ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর পদে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি অনবরত সাহিত্য সাধনা করে গিয়েছিলেন। এ সময় তাঁর সাথে দীনবন্ধু মিত্রের পরিচয় হয় যা পরবর্তীকালে অন্তরঙ্গতা লাভ করে। ছাত্রজীবনে কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর সাহিত্যিক সত্ত্বার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি নিজে পত্রিকা সম্পাদনার কাজ শুরু করেন যার নাম ছিল ‘বঙ্গদর্শন’ যেখানে তিনি একে একে দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ,সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ লিখতে থাকেন।

দীর্ঘ তেত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করার পর তিনি অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনের নানা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, নির্ভীক, কর্তব্যনিষ্ঠ ,দক্ষ শাসক ও সুবিচারক।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১১ বছর বয়সে নারায়নপুর গ্রামের মােহিনীদেবী নামক এক পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকার সাথে তার প্রথম বিয়ে করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত ১৮৫৯ সালে তার প্রথম স্ত্রী মারা যান। এর পর ১৮৬০ সালে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়।

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী

নাম (Name)বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Bankim Chandra Chatterjee)
জন্ম (Birthday)২৬ শে জুন ১৮৩৮ (26th June 1838)
অভিভাবক (Guardian) / পিতা ও মাতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (বাবা)
দূর্গাদেবী (মা)
ছদ্দনাম (Pseudonym)কমলাকান্ত (Kamalakanta)
দাম্পত্যসঙ্গী (Spouse)মােহিনীদেবী / রাজলক্ষ্মী দেবী
পেশা (Career)সরকারি কর্মকর্তা, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক
উল্লেখযোগ্য উপন্যাসদুর্গেশনন্দিনী , কপালকুন্ডলা , মৃণালিনী , বিষবৃক্ষ , ইন্দিরা , যুগলাঙ্গুরীয় , চন্দ্রশেখর , রাধারাণী , রজনী , কৃষ্ণকান্তের উইল , রাজসিংহ , আনন্দমঠ , দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম।
মৃত্যু (Death)৮ ই এপ্রিল ১৮৯৪ (8th April, 1894)
মৃত্যুস্থানকলকাতা ,পটলডাঙ্গায়
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী

সাহিত্যচর্চায় বঙ্কিম

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগের সঠিক প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে। তিনি ঐতিহাসিক ,সামাজিক, ব্যঙ্গ কৌতুক ,ধর্মীয়মূলক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন।তিনি তাঁর সাহিত্য সাধনার দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। কবিতা দিয়ে শুরু করলেও পরে উপন্যাস, প্রহসন, নাটক ,প্রবন্ধ প্রভৃতি লিখেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করেছিলেন বলে মানা হয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছিল তাঁর লেখা প্রথম স্বার্থক বাংলা উপন্যাস।একে একে তিনি পনের টি উপন্যাসের জন্ম দেন যার মধ্যে একটি ইংরেজি উপন্যাসও ছিল। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’, ‘রাজসিংহ’, ‘দেবীচৌধুরানি’, ‘আনন্দমঠ’, ‘সীতারাম’, ‘রজনী’, ‘বিষবৃক্ষ’,’কৃষ্ণকান্তের উইল’, ,’যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘ইন্দিরা’, ‘রাধারানী’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এই উপন্যাসগুলোকে ঐতিহাসিক, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মতত্ত্ব প্রভাবিত প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও তিনি ছিলেন খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক। তাঁর রচিত ‘আনন্দমঠ ‘,দেশবাসীর মধ্যে দেশপ্রেমের প্রেরণা জুগিয়েছিল।’আনন্দমঠে’, তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মন্ত্রের মতো কাজ করেছে।

১৯৩৭ সালে এই গানটি কে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের তুলনায় তাঁর প্রবন্ধে সংস্থাগত গুরুত্ব বেশি। সেই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে- ‘লোক রহস্য ‘,’বিজ্ঞান রহস্য’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘বিবিধ সমালোচনা’, ‘সাম্য’, ‘প্রবন্ধ পুস্তক’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’, ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘শ্রীমদ ভগবতগীতা’ প্রভৃতি বৈচিত্রের দাবি রাখে।’কমলাকান্তের দপ্তর’ ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের এক অনন্যসাধারণ ব্যঙ্গাত্মক রচনা। ছদ্মনাম হিসেবে তিনি ‘কমলাকান্ত’ নামটিই নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন । তিনি ই প্রথম বাংলা ভাষাকে তাঁর প্রকৃত মর্যাদা দিয়েছিলেন।বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা ‘বঙ্কিমী শৈলী’ বা ‘বঙ্কিমী রীতি’ নামে খ্যাতি অর্জন করেছে।

বঙ্কিমের রাষ্ট্রগীত রচনা

ব্রিটিশ বিরোধী গান ‘বন্দেমাতরম’ তাঁরই সৃষ্টি। যা সেই সময় বিপ্লবীদের মুখে মুখে ঘুরতো। ঋষি অরবিন্দ এই গানটিকে ‘বঙ্গদেশের জাতীয় সঙ্গীত’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এই গানটি ছিলো যা বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণে রচিত।

পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সম্মান

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর ও কালেক্টরের পদের অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে ‘কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করেন।

বঙ্কিমের দেহান্ত

৮ ই এপ্রিল, ১৮৯৪ (২৬ শে চৈত্র ১৩০০ বঙ্গাব্দ) সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তবে তাঁর রচনাশৈলীর মাধ্যমে তিনি আজও আমাদের মধ্যে অমর হয়ে রয়েছেন।

সামগ্রিকতার বিচারে উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে বাংলা সাহিত্যের ভগীরথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর প্রতিভা বলে বাংলা সাহিত্যের মরু প্রান্তরে পবিত্র মন্দাকিনী স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল।

বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে শৈশব অবস্থা থেকে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। শুধু নামেই নয়, প্রকৃত অর্থেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘সাহিত্য সম্রাট’ ছিলেন। তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা ,দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। তিনিই আমাদের মাতৃপূজার বোধন মন্ত্রের প্রথম বৈদিক ঋষি ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’!

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্ম মৃত্যু

নাম:বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
জন্ম:১৮৩৮ সালের ২৬ শে জুন
ছদ্মনাম:কমলাকান্ত
মৃত্যু:১৮৯৮ সালের ৮ ই এপ্রিল
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্ম মৃত্যু

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাণী

“পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’”।

“মরিলে যদি রণজয় হইত,তবে মরিতাম। বৃথা মৃত্যু বীরের ধর্ম নহে”

“যাকে ভালবাস তাকে চোখের আড়াল করোনা।”

“সাহিত্য ধর্ম ছাড়া নহে। কেননা, সাহিত্য সত্যমূলক। যাহা সত্য, তাহা ধর্ম। যদি এমন কুসাহিত্য থাকে যে তাহা অসত্যমূলক ও অধর্মময়, তবে তাহার পাঠে দুরাত্মা বা বিকৃতরুচি পাঠক ভিন্ন কেহ সুখী হয় না।”

“কাব্যগ্রন্থ মনুষ্যজীবনের কঠিন সমস্যা সকলের ব্যাখ্যা মাত্র, যিনি একথা না বুঝিয়া, একথা বিস্মৃত হইয়া, কেবল গল্পের অনুরোধে উপন্যাস পাঠে নিযুক্ত হয়েন, তিনি উপন্যাস পাঠ না করিলেই বাধিত হই।”

“মনুষ্যের সুখ মনুষ্যত্বে, এই মনুষ্যত্ব সকল বৃত্তিগুলির উপযুক্ত স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যের সাপেক্ষ। মনুষ্যের সমুদয় শক্তিগুলিকে চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা গেল: ১. শারীরিকী, ২. জ্ঞানার্জনী, ৩. কার্যকারিনী, ৪. চিত্তরঞ্জিনী। এই চতুর্বিদ বৃত্তির উপযুক্ত স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যই মনুষ্যত্ব।”

“যে কখনো রোদন করে নাই, সে মনুষ্য মধ্যে অধম। তাহাকে কখনও বিশ্বাস করিও না। নিশ্চিত জানিও সে পৃথিবীর সুখ কখনো ভোগ করে নাই। এর সুখও তাহার সহ্য হয় না।”

“তুমি সাহিত্য পাঠে অনুরক্ত এবং তাহাতে আনন্দ লাভ কর, তাহার কারণ এই যে, যে সকল বৃত্তির অনুশীলন করিলে সাহিত্যের মর্ম গ্রহণ করা যায়, তুমি চিরকাল সেই সকল বৃত্তির অনুশীলন করিয়াছ, কাজেই তাহাতে আনন্দ লাভ কর। যে সকল বৃত্তির অনুশীলনে ধর্মের মর্ম গ্রহণ করা যায়, তুমি সেগুলির অনুশীলন কর নাই, এজন্য তাহার আলোচনায় তুমি আনন্দ লাভ কর না।”

“সকল বিষয়েই প্রকৃত অবস্থার অপেক্ষা উত্কৃষ্ট আমরা কামনা করি। সেই উত্কর্ষের আদর্শস্থল আমাদের হূদয়ে অস্ফুট রকমে থাকে। সেই আদর্শ এবং সেই কামনা কবির সামগ্রী। যিনি তাহা হূদয়ঙ্গম করিয়াছেন, তাহাকে গঠন দিয়া শরীরী করিয়া আমাদের হূদয়গ্রাহী করিয়াছেন, সচরাচর তাঁহাকেই আমরা কবি বলি।”

“কুকাব্যও আছে। সে বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকা উচিত। যাহারা কুকাব্য প্রণয়ন করিয়া পরের চিত্ত কলুষিত করিতে চেষ্টা করে, তাহারা তস্করদিগের ন্যায় মনুষ্যজাতির শত্রু এবং তাহাদিগকে তস্করাদির ন্যায় শারীরিক দণ্ডের দ্বারা দণ্ডিত করা উচিত।”

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা বই

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস আনন্দমঠে একটি কবিতা “বন্দে মাতরম”, যা ১৯৩৭ সালে ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এছাড়া তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য আধুনিক উপন্যাসের লেখক ও সাহিত্য সম্রাট নামেও পরিচিতি পেয়েছেন। এছাড়া তিনি বঙ্গদর্শন নামক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকাটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অমূল্য অবদান রেখেছিল।

নিজের শুধু উপন্যাস রচনা করে গেছেন তা নয়। তিনি বেশকিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে “কমলাকান্তের দপ্তর” নামক প্রবন্ধ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে যেন এক বিশেষ সংযোজন। মূলত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “কমলাকান্ত” ছদ্মনামে সাহিত্য রচনা করেছিলেন। এই ছদ্মনামে লেখা কিছু প্রবন্ধ তিনি একত্রে “কমলাকান্তের দপ্তর” নামে বইটিতে সংকলন করেন। পাঠকমহলে “কমলাকান্তের দপ্তর” বইটি তুমুল সফলতা পেয়েছিল।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস pdf

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মূলত একজন ঔপন্যাসিক। তিনি মোট ১৫ টি উপন্যাস লিখেছেন। যার মধ্যে বাংলায় লিখেছেন ১৪ টি এবং একটি ইংরেজি উপন্যাস লিখেছেন। ইংরেজি উপন্যাসটির নাম হচ্ছে Rajmohan’s Wife.

১৮৬৮ সালের তিনি প্রকাশ করেন তার প্রথম উপন্যাস বিষবৃক্ষ। এটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক উপন্যাস বলা হয়ে থাকে। এর পূর্বেও বেশ কিছু উপন্যাস লেখার চেষ্টা হলেও সেগুলো সার্থক ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম সার্থক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করেন।

কপালকুণ্ডলা, বৃষবৃক্ষ, আনন্দমঠ ইত্যাদির মতো কালজয়ী উপন্যাস গুলো লিখেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া মৃণালিনী, ইন্দিরা, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাধারানী, রজনী, সীতারাম, চন্দ্রশেখর, যুগলাঙ্গুরীয়, দেবী চৌধুরানী ও রামমোহন’স ওয়াইফ তার লেখা অন্যান্য উপন্যাস। এদের মধ্যে দেবী চৌধুরানী, আনন্দমঠ, সীতারাম এই তিনটি উপন্যাসকে ত্রয়ী উপন্যাস বলা হয়, কারণ এই তিনটি উপন্যাসে হচ্ছে সিক্যুয়াল।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস সমূহের তালিকা–

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ উপন্যাস

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা সেরা ৫টি উপন্যাসঃ 

কমলাকান্তের দপ্তর

মোট ১৪ টি প্রবন্ধ নিয়ে লেখা বঙ্কিমচন্দ্রের এই প্রবন্ধ সংকলন। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালে। কমলাকান্ত বঙ্কিম বাবুর সৃষ্ট এক অভিনব চরিত্র। এই চরিত্রটি একাধারে কবি, দার্শনিক, ভাবুক, সমাজচিন্তাবিদ, ইতিহাসসন্ধানী, মানবপ্রেমিক, স্বদেশপ্রেমী, হাস্যরসিক, জীবনরসিক। এক কথায় লেখকেরই মানস রূপ।

বিষবৃক্ষ

এই উপন্যাসটি প্রথম ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়। বিষয়বস্তু ছিল  সমসাময়িক বাঙালি হিন্দু সমাজের দুটি প্রধান সমস্যা বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথা। নগেন্দ্র নাথ, কুন্দ এবং সূর্যমুখীর চরিত্রের মধ্যে দিয়ে লেখক তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা এবং সম্পর্কের জটিলতাকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। 

কৃষ্ণকান্তের উইল

কৃষ্ণকান্তের উইল ১৮৭৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ত্রিকোন প্রেমের কাহিনী কি করে এক সুপুরুষ খারাপ প্রবৃত্তির কাছে হেরে যায়।  ভ্রমরের সাথে গোবিন্দলালের দাম্পত্যের বিশ্বস্ততা যখন গোবিন্দলালকে যে কোনো নারীর আকাঙ্ক্ষিত পুরুষে পরিণত করে। ঠিক তখন অন্যদিকে গোবিন্দলাল পরাজিত হয় খারাপ প্রবৃত্তির কাছে। শেষে ভ্রমরের মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁকে জিতিয়ে দেন লেখক। 

কপালকুন্ডলা

এই উপন্যাসটি ১৮৬৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটিতে লেখক সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন নবকুমার এবং কপাল কুন্ডলার প্রেম, সমাজের আচার-আচরনের সাথে মানিয়ে নিতে কপাল কুন্ডলার সংগ্রাম। কাপালিক এবং নবকুমারের প্রথমা স্ত্রীর হিংসায় নবকুমার আর কপালকুণ্ডলার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। এবং শেষ পর্যন্ত উভয়েই জীবনের চরম পরিণতি।  

দুর্গেশনন্দিনী

বাংলা সাহিত্যের প্রথম এই সার্থক উপন্যাসটি ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে এক নারীর উঠে দাঁড়ানোর লড়াই। কিভাবে সমাজ ও শক্তির বিপরীতে গিয়ে তিনি তাঁর স্বামীর মৃত্যুর বদলা নেন। সেই ক্ষেত্রে এই উপন্যাসে বঙ্কিম বাবু এক মৌলিকত্বের ছোঁয়া রেখেছেন। 

বঙ্কিম রচনাবলী উপন্যাস

বঙ্কিম রচনাবলী উপন্যাস

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস মনে রাখার কৌশল

দুর্গেশনন্দিনী দেবী চৌধুরানী কপালকুণ্ডলা সীতারাম ইন্দিরা যুগলাঙ্গুরীয় এই তিন বোনের ভ্রাতা রাজসিংহের পরামর্শে রজনী অন্ধকারে কৃষ্ণকান্তের উইল চুরি করলে চন্দ্রশেখর আনন্দমঠে রাজমোহনস ওয়াইফের হাতে ধরা খেল।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবি

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবিতা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহু উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখলেও মাত্র একটি কবিতার গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। কবিতা লেখায় তার আগ্রহ ছিল কম, বরং কবিতা নিয়ে কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অথচ আনন্দমঠ উপন্যাসে তার একটি ছোট্ট কবিতার অংশ “বান্দে মাতারাম” এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে তৎকালীন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এটিকে ভারতের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করে। বর্তমানেও ভারত সরকার এই কবিতাটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

তার লেখা একমাত্র কবিতার বইটির নাম হচ্ছে কবিতাপুস্তক। এখানে শতাধিক কবিতা স্থান পেয়েছে। যদিও কবিতার বইটি তার অন্যান্য সাহিত্য রচনা মত অতটা বিখ্যাত হতে পারেনি, তবুও কবিতাগুলো অত্যন্ত সুখপাঠ্য।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সত্য ও ধর্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য “। খ্যাতি বা অর্থের উদ্দেশ্যে লেখা নয়; লিখতে হবে মানুষের কল্যাণ সাধন কিংবা সৌন্দর্য সৃষ্টির অভিপ্রায়ে।

আরো অন্যান্য অতি জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় MCQ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন উত্তর

Q1. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ছদ্মনাম

Ans – তিনি ছদ্মনাম হিসেবে কমলাকান্ত নামটি বেছে নিয়েছিলেন।

Q2. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন

Ans – তিনি বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র বঙ্গদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।

Q3. সাহিত্য সম্রাট কে?

Ans – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে সাহিত্য সম্রাট বলা হয় ।

Q4. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস কয়টি

Ans – বঙ্কিমচন্দ্র মােট চোদ্দটি উপন্যাস রচনা করেন ।

Q5. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রথম উপন্যাস কোনটি

Ans – বাংলা ভাষায় রচিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস “দুর্গেশনন্দিনী” (১৮৬৫)।


আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।