উন্নয়ন কাকে বলে, স্থিতিশীল উন্নয়ন কাকে বলে

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

সূচিপত্র

উন্নয়ন কাকে বলে

সাধারণভাবে উন্নয়ন হল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সার্বিক অগ্রগতি। এটি নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উন্নয়নের ধারণাটি সময়ের সাথে সাথে অঞ্চলভেদে পৃথক হয়। সেকারণে উন্নয়নের কোনাে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা ধারণা পাওয়া যায় না। অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ, রাজনীতিবিদ, ভূগােলবিদ এবং ঐতিহাসিকরা তাদের নিজস্ব নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উন্নয়নের ধারণা প্রদান করেছেন।

উন্নয়নের ধারণার আলােচনা প্রসঙ্গে সবথেকে বেশি অবদান রয়েছে অর্থনীতিবিদদের। তারা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উন্নয়নের ধারণা প্রদান করেছেন। তাদের মতে উন্নয়ন হল একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটে এবং এর সাথে দারিদ্র্য ও বৈষম্যের অবসান ঘটে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামাের পরিবর্তনও উন্নয়নের মাধ্যমের ঘটে।

উন্নয়ন সম্পর্কে আলােচনায় ভূগােলবিদদের ধারণা সর্বব্যাপক। তারা উন্নয়নের ধারণায় অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির অগ্রগতির সাথে সাথে পরিবেশগত দিককেও তুলে ধরেছেন।

উন্নয়নের সংজ্ঞা দাও

প্রকৃতপক্ষে ‘উন্নয়ন’ হলো এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ, যার কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই। ‘উন্নয়ন’ শব্দটির সমার্থক শব্দসমূহের মধ্যে আছে বিস্তৃতি, প্রসারণ, বিবর্তন, বৃদ্ধি, প্রগতি, অগ্রগতি, উত্তরণ, বিকাশ ইত্যাদি। আবার ‘উন্নয়ন’ শব্দের বিপরিতার্থক শব্দগুলোর মধ্যে যা আছে তা হলো- প্রত্যাবৃত্তি, পশ্চাদগমন করা, প্রত্যাবর্তন করা ইত্যাদি।

সাধারণভাবে বলা যায় – উন্নয়ন হলো অগ্রগতি, বৃদ্ধি অথবা ব্যপকতার ফল স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েছে এমন কিছু। অভিধানে উন্নয়নকে সংক্ষেপে বলা হয়েছে, “A process of unfolding, maturing and evolving.”। উন্নয়নের এই অর্থ ও ধারণা মানব সমাজের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। উন্নয়ন হলো কোনো কিছুর কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বা উত্তরণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে উন্নয়ন অর্থ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশ তথা জাতিকে আধুানকায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও দেশের সঞ্চয়, বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধি এসব নিশ্চিত করা। অ্যাডাম স্মিথ জাতীয় উন্নয়ন বলতে সামগ্রিকভাবে পুঁজি সঞ্চয়নকে বুঝিয়েছেন। সেসময় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবক্তারা মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধিকে জাতীয় উন্নয়ন মনে করতেন।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতে উন্নয়নের সংজ্ঞা

  • নাটা বলেছেন, “উন্নয়ন হলো প্রচ্ছন্ন উৎপাদনের একটি প্রসারণ”।
  • শুমপিটার বলেছেন, “উন্নয়ন হলো বাহ্যিক উদ্দীপনার ফলশ্রুতি”।
  • কিল্ডালবার্গার ও হেগেলে বলেছেন, “উন্নয়ন হলো কাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে উৎপাদন বৃদ্ধি”।
  • বয়ার ও ইয়াম বলেছেন, “উন্নয়ন হলো জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধাদির পছন্দগত সম্প্রসারণ”।
  • হার্বিসন ও মায়ার্স বলেছেন “অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় একটি দেশের মানুষের প্রকৃত মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়”।
  • Mahbubul Haq, Paul Stitin, James Grants and others (1970) বলেন, “সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন”।
  • ILO বলেছে, “মানুষের জন্যে খাদ্য ও পুষ্টি, মৌলিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, গৃহায়ন ইত্যাদি সুবিধা সৃষ্টি করাই উন্নয়ন”।
  • প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “উন্নয়ন অর্থ হলো দেশের নিচের অর্ধেকাংশ (আয় বিন্যাসে যারা মধ্যম আয়ের নিচে অবস্থান করে) মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক উন্নতি”। তাঁর মতে, যে কর্মসূচি বা কর্মোদ্যোগ দেশের নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে সেটাকেই শুধু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বলা যাবে।
  • অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন্ম “উন্নয়ন হলো মানুষের স্বাধীনতাকে সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া”। তিনি মনে করেন, উন্নয়ন মানে স্বাধীনতা। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন প্রমাণ করেছেন যে, শুধু নিম্ন আয়ই নয়; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার পশ্চাদমুখীতাই দারিদ্রের অন্যতম কারণ।

উন্নয়নের বৈশিষ্ট্যসমূহ

[1] বহুমুখী প্রক্রিয়া : উন্নয়ন একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া। কোনাে নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

[2] অঞ্চলভেদে পৃথক : পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার প্রাকৃতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই, উন্নয়নের ধারণা সবজায়গায় সমান নয়।

[3] গতিশীল প্রক্রিয়া : সময়ের সাথে সাথে উন্নয়নের ধারণার পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ, এটি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া।

[4] বিকাশ-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত : বিকাশ ঘটলে তবেই উন্নয়ন ঘটবে। তাই উন্নয়ন বিকাশের সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্কযুক্ত।

[5] ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে ঘটে : উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন উপাদানগুলির ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে ঘটে।

[6] সমাজবন্ধ প্রক্রিয়া : উন্নয়ন একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। সমাজ বহিভূর্ত হয়ে উন্নয়ন কখনও ঘটতে পারে না।

স্থিতিশীল উন্নয়ন কাকে বলে

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা বজায় রেখে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটানোকে স্থিতিশীল উন্নয়ন বা ধারণযোগ্য উন্নয়ন বলা হয়। 1987 খ্রিস্টাব্দে ব্রুন্ডল্যান্ড কমিশনের রিপোর্টের সর্বপ্রথম স্থিতিশীল উন্নয়ন শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়। স্থিতিশীল উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদগুলোকে এমন ভাবে ব্যবহার করা হয়, যাতে সেগুলি নিঃশেষিত হয়ে না যায় বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়।

স্থিতিশীল উন্নয়ন কি, টেকসই উন্নয়ন কি

টেকসই উন্নয়ন শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৮৭ সালে ব্রুন্ডল্যান্ড কমিসনে। ব্রুন্ডল্যান্ড কমিশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা মেটানোর ক্ষমতাকে বজায় রেখে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটানোকেই টেকসই বা স্থিতিশীল উন্নয়ন বলে।

স্থিতিশীল উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য 

১) স্থিতিশীল উন্নয়ন এক ধরণের কার্যাবলি যা পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন মূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে সাহায্য করে।

২) স্থিতিশীল উন্নয়ন এ প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশের গুনগত মান বজায় রেখে মানুষের জীবন যাত্রার মানের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়।

৩) মানুষ যে প্রাকৃতিক সম্পদ ও সাংস্কৃতিক সম্পদ গুলো ব্যবহার করছে, সেগুলি হ্রাস বা ধ্বংস না করে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।  

স্থিতিশীল উন্নয়নের নীতি, স্থিতিশীল উন্নয়নের নীতি গুলি কি কি

১. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পদের ব্যবহার 

২. জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ

৩. এমন ভাবে সম্পদের ব্যবহার করা, যাতে সামাজিক ন্যায় বজায় থাকে

৪. সম্পদের পুনব্যবহার

৫. মানুষের গুনগত মানের বিকাশ – ভালো স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উচ্চ মাথা পিছু আয়

৬. পরিবেশ সম্পর্কীত বিষয় গুলি বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা

৭. মানুষ কে বিশ্ব সম্পদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বোঝানো।

৮. স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য সকলের অংশগ্রহণ আবশ্যক

স্থিতিশীলতার নির্দেশক (Indicators) গুলি হল

১. বাস্তুসংস্থানিক নির্দেশক – এটি ভূমি ব্যবহারের নমুনা,  ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, জীবভরের গুন ও পরিমান, জলের গুন ও পরিমান, মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা ও শক্তি সম্পদের প্রাচুর্যতা প্রভৃতি অন্তভুক্ত করে।

ক)  ভূমি ব্যবহার ও ভূমি আচ্ছাদন পরিবর্তন প্যাটার্ন – রাজস্ব আদায়ের রেকর্ড এবং রিমোর্ট সেন্সিং পদ্ধতির ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমান ভূমি ব্যবহার প্যাটার্ন ও সময়ের সাথে সাথে যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বিশ্লেষণের দ্বারা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেওয়া ।

খ) জীবভরের গুনমান ও পরিমান – স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্র থেকে উৎপন্ন জীব ভরের পরিমান ও তার গুনমান বাস্তুতন্ত্রের এক গুরুত্বপুর্ন নির্দেশক।

গ) জলের গুনমান ও পরিমান – জীব তথা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জল অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। স্বাদু জলের গুনমান ও পরিমানের যথা যথ পর্যালোচনা করা পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের অপর একটি গুরুত্ব পূর্ন নির্দেশক।

ঘ) মৃত্তিকার উর্বরতা – বিবেচনা সম্মত জমির ব্যবহার ও শস্যাবর্তন পরিবেশের উৎপাদন শীলতা ও স্থায়িত্ব নির্দেশ করে।

ঙ) শক্তি সম্পদ – শক্তি বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের গুরুত্ব পূর্ন উপাদান। এটি সৌরশক্তি, জীবাশ্ম জ্বালানি, ভূতাপ বিদ্যুৎ প্রভৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। বাস্তুতন্ত্রের শক্তির একমাত্র উৎস হল সূর্য।

২) অর্থনৈতিক নির্দেশক – 

ইনপুট ও আউটপুট অনুপাত স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্ব পূর্ন অর্থনৈতিক নির্দেশক। মোট জাতীয় উৎপাদক কোনো দেশের জাতীয় স্তরের নির্দশক হিসাবে কাজ করে।

৩) সামাজিক নির্দেশক –

সামাজিক নির্দেশক হিসাবে জীবন যাত্রার মান খুবই গুরুত্বপূর্ন। জীবনযাত্রার উচ্চ মান বাস্তুতন্ত্রের ভালো স্থায়িত্ব কে নির্দেশ করে।

সুস্থায়ী উন্নয়ন কাকে বলে

সুস্থায়ী উন্নয়নের প্রধান বিষয়ের মধ্যে ব্রান্ডটল্যান্ড প্রতিবেদনে অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল যেমন – আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ভূমিকা, জনসংখ্যা এবং মানব সম্পদ, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রজাতি এবং বাস্তুতন্ত্র, শক্তি, শিল্প এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রস্তাবিত আইনি নীতিগুলি।

১. সুস্থায়ী উন্নয়ন সম্বন্ধে প্রথম বলেন Allen (1980)। তিনি তাঁর The World Conservation Strategy পুস্তকে সুস্থায়ী উন্নয়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন,”উন্নয়ন হচ্ছে মানুষের জীবনের গুনগত মানের এবং মানুষের চাহিদার স্থায়ী সন্তুষ্টি অর্জনের ব্যবস্থা করা।”

২. Earnest Simonis Euco (1983) এর মতে “সুস্থায়ী উন্নয়ন বলতে সেই উন্নয়ন প্রকল্পকে বোঝায়,যার মাধ্যমে দীর্ঘকাল যাবৎ প্রাকৃতিক গুনগত মান ও কার্যকারিতা অহ্মুন্ন রেখে সর্বাধিক অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করা যায়।”

৩. Robert Repetto তাঁর Global Possible পুস্তকে (1886) বলেছেন,”সুস্থায়ী উন্নয়ন বলতে সেই সময় উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বোঝায়,যা দীর্ঘকাল স্থায়ী সম্পত্তি ও প্রকৃতিদত্ত সৃষ্টি ও উন্নয়নের জন্য সবধরনের প্রাকৃতিক ও মানবীয় সম্পদ গুলির এবং অর্থনৈতিক ও ভৌত সম্পত্তির সঠিক পরিচালনা করে।

৪. World Commission On Environment And Development (WCED) 1983 সালে রাষ্ট্রসংঘ দ্বারা গঠন করে।Gro. Harlem Brundtland ছিলেন WCED এর সভাপতি। তাঁর নামানুসারে WCED Brundtland Commission নামে পরিচিত লাভ করেছে। Brundtland Commission এর দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন মেটানোর হ্মেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর জন্য যে পরিকল্পনা গ্ৰহন করা হয়,তাকে সুস্থায়ী উন্নয়ন বলে।”

৫. Dictionary Of Geography তে বলা হয়েছে সুস্থায়ী উন্নয়ন হল উন্নয়নের এমন একটি ধারা যার ভিত্তি সম্পদের সুবিবেচনা প্রসূত ব্যবস্থাপনা।যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য আসে।

৬. Dictionary Of Ecology তে বলা হয়েছে,সুস্থায়ী উন্নয়ন হল অর্থনৈতিক উন্নয়ন যা অর্থনৈতিক কার্যাবলীর পরিবেশগত পরিণতির পূর্ণ বিবেচনা করে এবং সেইসব সম্পদের ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে যা প্রতিস্থাপন যোগ্য ও পুনর্ভব। সুতরাং সেগুলির বিনাশ হয় না।

সুস্থায়ী উন্নয়ন কাকে বলে এর প্রধান লক্ষ্য গুলি লেখ

1989 খ্রিস্টাব্দে Coalition for Environmentally Responsible Economics বা CERES দশটি মূলনীতি নির্ধারণ করে।এগুলি হল –

১. জীবমন্ডলের সুরহ্মা – 

বাতাস,জল,ভূমি বা তার অধিবাসীদের পরিবেশের হ্মতি করে এমন কোনও দূষণকারী পদার্থ নির্গমন করা চলবে না।নদী-হ্রদ, জলাভূমি,উপকূল অঞ্চল এবং সামুদ্রিক পরিবেশকে অহ্মুন্ন রাখতে হবে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ানো,ওজোন স্তরের হ্মতি সাধন,অম্লবৃষ্টি বা ধোঁয়াশা সৃষ্টিকারী পদার্থ কমাতে হবে।

২. প্রাকৃতিক উপকরণের ধারণযোগ্য ব্যবহার –

পুর্নবার ব্যবহারযোগ্য প্রাকৃতিক উপকরণ,তেমন জল,মাটি ও জঙ্গলের ধারণযোগ্য ব্যবহার করতে হবে।যেসব উপকরণ হ্ময়িভূত সেগুলিকে সু পরিকল্পিত ও দহ্মভাবে ব্যবহার করতে হবে।

৩. বর্জ্য পদার্থ কমানো ও সঠিকভাবে ফেলা –

সবরকম বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ হ্রাস করা দরকার। বিশেষ করে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ দায়িত্বশীল ভাবে ফেলা প্রয়োজন।সম্ভবপর হ্মেত্রে বর্জ্য পদার্থ পুর্নবার ব্যবহার করা।

৪. শক্তির সুব্যবহার –

পরিবেশগত ভাবে নিরাপদ এবং ধারনাযোগ্য শক্তির উপকরণ ব্যবহার, উৎপাদন পদ্ধতির সাধনের মাধ্যমে শক্তির দহরম ব্যবহার করা প্রয়োজন।

৫. ঝুঁকি কমানো –

নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশগত,স্বাস্থ্যগত এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি কমানো দরকার।

৬. নিরাপদ দ্রব্য ও পরিষেবার বিপনন –

এমন ধরনের দ্রব্য এবং পরিষেবার বিপনন করা উচিত যার পরিবেশগত অভিঘাত ন্যূনতম এবং সাধারণ ভোক্তার কাছে নিরাপদ।

৭. পরিবেশগত হ্মতিপূরণ –

পরিবেশের হ্মতিসাধন করলে সেই হ্মতিপূরণ করে দিতে হবে এবং পরিবেশকে আগের রূপে ফিরিয়ে দেবার দায়িত্ব নিতে হবে।সেইসঙ্গে যত মানুষ হ্মতিগ্ৰস্থ হয়েছেন, তাঁদের হ্মতিপূরণ করতে হবে।

৮. সূচনা –

কিভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া চলছে, তার পরিবেশগত ঝুঁকি কি হতে পারে,স্বাস্থ্যের কি হ্মতি হতে পারে – এসব বিষয় সম্পর্কে আগে থেকে সূচনা দিতে হবে।

৯. পরিবেশগত ব্যবস্থাপক –

প্রতিটি কোম্পানিতে অন্ততপহ্মে একজন ব্যবস্থাপক পরিবেশগত দিকগুলির বিষয়ে দায়িত্ব নেবেন।

১০. মূল্যায়ন ও বাৎসরিক হিসাব –

প্রতিটি কোম্পানি প্রতিবছর নিয়ম করে তাদের কাজকর্মের পরিবেশগত মূল্যায়ন ও বাৎসরিক হিসাব দাখিল করবেন।

সুস্থায়ী উন্নয়ন কার্যকর করার জন্য 1992 সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে “Earth Summit” নামক অধিবেশনে যে যে বিস্তারিত নীতি গৃহিত হয়, সেগুলি হল –

  • পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হবে। বনভূমির নবীকরণ,ভূমিহ্ময় নিবারণ ও দূষণ রোধ করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
  • স্বল্প জন্মহার মৃত্যু হারের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  • শক্তি সম্পদ ব্যবহারের হ্মেত্রে দহ্মতা বাড়াতে হবে,অপচয় রোধ করে পূর্নভব সম্পদগুলি যেমন – জল, বাতাস, সৌরশক্তি,ভূতাপীয় শক্তি প্রভৃতি ব্যবহারের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
  • চিরাচরিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবর্তে সুস্থিত উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
  • গচ্ছিত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার কমাতে হবে। অপরদিকে অচিরাচরিত ও পরিবর্ত দ্রব্যের যেমন – পুরাতন কাগজ,স্ক্র্যাপ লোহা,প্লাস্টিক প্রভৃতির পুনব্যবহার করে ব্যবহার বাড়াতে হবে।
  • চাহিদা পূরণের হ্মেত্রে বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত পদহ্মেপ নিতে হবে।
  • বিশ্বের সকল দেশগুলির মধ্যে রাজনৈতিক সুসম্পর্ক স্থাপন ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে পারস্পরিক যোগাযোগের ভিত্তি মজবুত করতে হবে।
  • শ্রম ও দহ্মতার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
  • আন্তর্জাতিক সুরহ্মা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
  • সম্পদ ও পণ্যের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
  • যুদ্ধবিগ্ৰহ বন্ধ করতে হবে। নিরস্ত্রীকরণ ও বিশ্বশান্তির পথ প্রশস্ত করতে হবে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাকে বলে

উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা দ্বারা একটি দেশের আর্থসামাজিক উপাদান যেমন- অবকাঠামো, জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, উৎপাদন ক্ষমতা, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদির সম্মিলিত অবস্থার ইতিবাচক দিক নির্দেশ করে। কোনো দেশ বা জাতির উন্নয়ন সেদেশের সামাজিক মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদির ইতিবাচক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। একটি দেশের সামগ্রিক চিত্র ঐদেশের সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমেই ফুটে ওঠে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে কী বোঝো

কোনো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতের একযোগে উন্নতির অগ্রগতিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে। বলা যায় যে, একটি দেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামো, জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, উৎপাদন ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মানের ক্রমোন্নতির এক দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া হলো উন্নয়ন। অর্থাৎ উন্নয়ন হলো একটি দীর্ঘকালীন চলমান প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি দেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামোগত অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকে। তবে অর্থনীতিতে উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই বুঝায়। তাই বলা যায়, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি ও শিল্পপণ্য, খনিজ দ্রব্য, সাংস্কৃতিক অবস্থা, কুসংস্কারমুক্ত সামাজিক অবস্থা প্রভৃতি ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটলে তাকে উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে।

তাই বলা যায়, কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেবল একটি দেশের দেশজ আয় বা জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায় না, বরং এর সাথে দেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামোরও মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এর ফলে মানব উন্নয়ন ঘটে এবং শ্রমিকের কর্মক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় । বর্তমানে ‘উন্নয়ন’ ও ‘প্রবৃদ্ধি’ শব্দ দুটিকে প্রায় একই অর্থে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। একটি দেশের অধিক উৎপাদন এবং একই সাথে কারিগরি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদন ও বণ্টনের পরিবর্তনকে উন্নয়ন হিসেবে অভিহিত করা যায়। তবে প্রবৃদ্ধি বলতে অধিক উৎপাদনকে বা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকে নির্দেশ করা হয় । তাই কোনো দেশের উন্নয়ন হচ্ছে কি না তা বুঝাতে হলে নিম্নোক্ত শর্তসমূহ মনে রাখা দরকার,

  • ১. সেদেশের মাথাপিছু আয় সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হতে হবে।
  • ২. সেদেশের জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয়ের বার্ষিক বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হতে হবে।
  • ৩. সেদেশের অর্থনীতি স্বধারায় পুষ্ট হতে হবে।

তাই উন্নয়ন বলতে শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধিকে বুঝায় না। কেননা উন্নয়নের একটি অংশ হিসেবে অর্থনীতি বা কোনো খাতের সম্প্রসারণের ফলে প্রবৃদ্ধির সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এ সম্প্রসারণ অন্যান্য খাতে প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারলে অথবা এর সুফল জনগণের কাছে না পৌঁছলে প্রবৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও উন্নয়ন হবে না। অর্থাৎ উন্নয়ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত করে । কিন্তু প্রবৃদ্ধি আবশ্যিকভাবে উন্নয়ন নির্দেশ করে না। অর্থাৎ কোনো দেশে উন্নয়ন সংঘটিত হলে প্রবৃদ্ধি হতে পারে, আবার উন্নয়ন না হলেও সেদেশে প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় যে, উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। কোনো দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি, বেকার সমস্যার সমাধান, আর্থসামাজিক অবকাঠামোর উন্নতি, জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ, সম্পদের সুসম বণ্টন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারকে উন্নয়ন বুঝায়। অর্থাৎ উন্নয়ন দ্বারা একটি দেশের পরিপূর্ণ চিত্র প্রদান করা হয়।

মানব উন্নয়ন কাকে বলে

মানুষের জীবনের সমৃদ্ধি বা Richness সম্প্রসারণ বা বৃদ্ধি করাই মানব উন্নয়ন। এই উন্নয়নে মানুষের ওপর জোর দেয় বেশি; পুরো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা অগ্রগতির ওপর নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের জীবনকে আরও উন্নত করা, সহজ করা এবং সমৃদ্ধ করার ওপর জোর দেয়। এখানে মানুষের জন্য ‘সুযোগ’ ও ‘পরিবেশ’ তৈরি করা হয় এবং এই ‘সুযোগ’ ও ‘পরিবেশ’ পাওয়ার পর সেই মানুষ যাতে নিজে ‘পছন্দ’ বাছাই করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়।

অনেকে মনে করেন দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সে দেশের মানুষের জীবন উন্নতি হবে, অর্থনীতির সমৃদ্ধির ফসল সবাই ভোগ করতে পারে। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি মনে করে অর্থনীতির সমৃদ্ধি বা অগ্রগতি হলেও সেটা গ্যারান্টি দেয় না যে, দেশের সব মানুষ সেই অগ্রগতি ও সুফল ভোগ করতে পারে বা সেই সুফলে লাভবান হবে। মানব উন্নয়ন মানুষকে তাদের পছন্দের এবং প্রত্যাশিত জীবন পরিচালনা করার সুযোগ দেয়; যে জীবনকে তারা সম্মান করে এবং এর উন্নয়নে মনোযোগী হয়।

মানব উন্নয়ন মানুষের সক্ষমতা উন্নয়ন করে এবং এই সক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, একজন আদিবাসী শিশুকে আমরা শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করে তুলতে পারি কিন্তু সেই দক্ষতার কোন মূল্য থাকবে না তাকে যদি চাকুরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত করি কিংবা সেই চাকুরির বাজারে সে যদি সেই দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ না পায়।

মানব উন্নয়নের তিনটি মূল স্তম্ভ রয়েছে:

  • ১. একটি দীর্ঘ, স্বাস্থ্যসম্মত ও সৃজনশীল জীবন পরিচালনা
  • ২. তথ্যসমৃদ্ধ ও দক্ষতাপূর্ণ জীবন পরিচালনা এবং
  • ৩. একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সুখী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের ওপর প্রবেশাধিকার থাকা।

মানুষ যদি এই তিনটি প্রয়োজনীয় বিষয় লাভ করে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সে যে জীবন প্রত্যাশা করে সেই জীবনটা পরিচালনা করতে পারে। তাই বলা হয়, মানব উন্নয়ন মানুষকে বিভিন্ন ‘সুযোগ’ দেয় এবং তাকে তার ‘পছন্দ’ লাভ করতে সহায়তা করে।

আরো পড়তে: পর্বত কাকে বলে, ভঙ্গিল পর্বত কাকে বলে, স্তুপ পর্বত কাকে বলে

ধারণযোগ্য উন্নয়ন কি, ধারণযোগ্য উন্নয়ন কাকে বলে

বর্তমানের চাহিদামতো প্রয়োজন মিটিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন মেটাবার জন্য সম্পদ সংরক্ষণকে উন্নয়ন বলে । অন্যভাবে বলা যায় , জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাড়ার বহনক্ষম অর্থনৈতিক প্রসার ও স্ব – বহনক্ষম পরিবেশ ও স্ব – বহনক্ষম সামাজিক অগ্রাধিকার রক্ষিত হলে তাকে স্থিতিশীল উন্নয়ন বলে ।

যে উন্নয়ন বৈদেশিক ঋণের বোঝার হাত থেকে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মুক্ত করে , ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দক্ষতা ও মানবিক গুণাবলী বৃদ্ধি করে , পরিবেশের অবনতি , গ্রাসরোধ করে তাকে স্থিতিশীল বা ধারণযোগ্য উন্নয়ন বলে ।

পরিবেশ ও উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক, পরিবেশের উপর উন্নয়নের প্রভাব

আর্থনীতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন হল পৃথিবীতে একধরনের আধিপত্যাধীন অর্থব্যবস্থার সর্বজনীন ক্রিয়াশীলতা ও বিস্তার। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে এই প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটেছে। ‘কাঠামোগত পুনর্গঠন কর্মসূচী’ (structural adjustment programme)-র মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া আপাতত পরিণতি লাভ করেছে ‘গ্যাট’ (GATT General Agreement on Tariff and Trade) চুক্তিতে। এই অর্থব্যবস্থা হল বিশ্বজনীন। এর ভিত্তি হল স্বাধীন বা মুক্ত বাণিজ্য। স্বাধীন বাণিজ্য ক্রিয়ায় সকল বিশ্বের সকল দেশ অংশগ্রহণ করবে। আন্তর্জাতিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্রিয়ার শর্তাদির প্রবল চাপে জাতীয় উৎপাদনের ধারা বা কাঠামো যাবে বদলে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর সকল দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শর্তসমূহ চেপে বসবে।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রতিকূল পরিণাম পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদান প্রদান ঘটেছে। তার ফলে সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার অনেকাংশে আঞ্চলিক স্তর থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে উপনীত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে পরিকাঠামোগত সংস্কার নীতির প্রবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সংস্কার নীতিসমূহের প্রয়োগের পরিণামে জনজীবনে বহু ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নয়নে উদ্যোগী দেশগুলিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সরকারী সাহায্যের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে অধিকাংশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কর্মসূচী অব্যাহত থাকছে।

পরিকাঠামোগত সংস্কার নীতি ও কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতে উন্নতিকামী দেশগুলিতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারী বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রতিকূল প্রভাব প্রথম পড়ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর এবং তাদের মহিলাদের উপর। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারী বরাদ্দ হ্রাস পেলে ব্যক্তিগত ব্যয় বৃদ্ধি পায়। দরিদ্রদের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার পরিবারের শিক্ষা স্বাস্থ্যের প্রাথমিক দায়িত্ব মহিলাদের উপরই বর্তায়। শিশুর শিক্ষা ও শিশুকে মানুষ করার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে মহিলারাই গ্রহণ করে। পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যের দিকেও মহিলাদেরই নজর রাখতে হয়।

উন্নয়নকামী দেশগুলির উপর বিশ্বায়নের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে ইতিমধ্যে সমাজতত্ত্ববিদরা বিবিধ সমীক্ষা সম্পাদন করেছেন। সংশ্লিষ্ট সমীক্ষা সূত্রে এক হতাশাজনক সামাজিক-মানবিক পরিস্থিতির পরিচয় পাওয়া যায়। বিশ্বায়নের পরিকাঠামোগত সংস্কার কর্মসুচীর কারণে বিবিধ মানবিক সূচক নিম্নমুখী। উন্নয়নকামী দেশগুলিতে রোগ-অসুখের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, আগেকার দিনের রোগ-অসুখের প্রত্যাবর্তন ঘটছে। কম ওজনের শিশু জন্মাচ্ছে এবং শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছে। শিক্ষার হার ও মান হ্রাস পাচ্ছে। পৃথিবীর ধনী ও দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান দিনে দিনে বাড়ছে। আবার সম্পদশালীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র এবং দরিদ্রদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্পদশালীর মধ্যেও পার্থক্য ক্রমান্বয়ে লক্ষণীয় হয়ে উঠছে।

এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশসমূহের স্বাস্থ্য খাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বিশেষভাবে হ্রাস পাচ্ছে। স্বাস্থ্য প্রকল্পসমূহে সরকারী ব্যয় সংকোচের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারসমূহের সদস্যদের, বিশেষতঃ মহিলাদের স্বাস্থ্য হানি ঘটছে। সংক্রামক ব্যাধির এবং অন্যান্য ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর হারও বাড়ছে।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে খাদ্যে সরকারী ভরতুকী ব্যাপকভাবে কাটছাট করা হচ্ছে। তার ফলে গরীব মানুষের মধ্যে অনাহার-অপুষ্টি বাড়ছে। বিশেষতঃ দরিদ্র পরিবারের মহিলা ও শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্বায়নের পরিকাঠামোগত সংস্কারনীতির প্রতিকূল প্রভাব সব থেকে বেশী পড়েছে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র মহিলাদের উপরে। দরিদ্র মহিলাদের দুঃখ-দুর্দশা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির গরীব শ্রেণীর মহিলাদের মধ্যে অপুষ্টি জনিত সমস্যাদি এবং মৃত্যুর হারের আধিক্য আজকের নয়, বরাবরের। স্বভাবতই বিশ্বায়নের সংস্কার নীতির প্রতিকূলতার শিকার হয়েছেন বিশেষভাবে এই শ্রেণীর মহিলারা।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির আর্থনীতিক ব্যবস্থায় বিশ্বের বহুজাতিক সংস্থাসমূহের দাপট বেড়েছে এবং কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নতিকামী দেশগুলির কলকারখানাসমূহের পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। শিল্পমালিকরা কারখানার পরিবেশকে স্বাস্থ্যসম্মত করার বিষয়টিকে অবহেলা বা উপেক্ষা করেন। স্বাস্থ্যহানির শিকার হয় দরিদ্র শ্রমিকরা। বিশ্বায়নের সংস্কারনীতির কারণে কলকারখানায় নারী শ্রমিকদের বিধিবহিঃকরণ ও প্রান্তিকরণ ঘটেছে। স্বভাবতই এই সমস্ত দেশের মহিলাদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা অধিক এবং মৃত্যুর হারও অধিক।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রসদ নিষ্কাশনের গতি-ধারা ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের ভোগের প্রক্রিয়ায় উচ্ছৃঙ্খলতা এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এবং পরিবেশের অবক্ষয় ঘটছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষয়-দূষণ ক্রমান্বয়ে সংকটের দিকে অগ্রবর্তী হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিচারে মানুষের জীবনধারার এবং মানুষের ক্রিয়াকর্মের বাঞ্ছিত পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবেশ সংরক্ষণের সহায়ক কর্মসূচী প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অন্যথায় প্রাকৃতিক পরিবেশের অবক্ষয় আটকান যাবে না। মানুষ প্রজাতিসহ সমগ্র জীবজগতের লালন-পালনের ক্ষমতা প্রকৃতি অবশেষে হারাবে।

আরো অন্যান্য অতি জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | উন্নয়ন

Q1. উন্নয়ন কি

Ans – পূর্বের অবস্থা থেকে উত্তরনকে উন্নয়ন বলে,যেটা একটি চলমান প্রক্রিয়া । ভালোর যেমন শেষ নেই তেমনি উন্নয়নেরও শেষ নেই। তবে পূর্বের অবস্থা থেকে ভালো অবস্থানে কোন কিছু বিদ্যমান থাকাকে উন্নয়ন বলা যায়।

Q2. অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক কি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক কি

Ans – অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকগুলো হলো– ১. জাতীয় আয়, ২. মাথাপিছু আয়, ৩. অর্থনৈতিক কল্যাণ ও ৪. মানব উন্নয়ন সূচক।

Q3. সামাজিক উন্নয়নের বিষয় গুলো কি কি

Ans – সামাজিক উন্নয়ন হলো সমাজের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন। অর্থাৎ জীবনমান,শিক্ষার হার এবং শ্রমিকের স্তরের উন্নতি করা। পারে। সমাজের সাফল্য প্রতিটি নাগরিকের কল্যাণের সাথে যুক্ত।

Q4. মানব উন্নয়ন সূচক কাকে বলে

Ans – মানব উন্নয়ন সূচক (Human development index) হলো এমন একটি যৌগিক সূচক বা স্কেল, যার দ্বারা কোনো একটি দেশের নাগরিক কতটা ভালো জীবনযাপন করে এবং সেই দেশ কতটা উন্নত তা বোঝা যায়।
কোনো একটি দেশ মানব উন্নয়ন সূচকে কতটা ভালো স্কোর করবে ত নির্ভর করে বেশ কয়েকটি অন্যান্য সূচকের উপর,যেগুলি হলো :

১) সেই দেশের মানুষের গড় আয়ু।
২) সেই দেশের মানুষের শিক্ষার মান ( শিক্ষার হার, বিদ্যালয়ে তালিকাভুক্তির সংখ্যা, বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার)
৩) দেশের মানুষের মাথপিছু গড় আয় ।

Q5. গণতন্ত্র কি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক

Ans – গণতান্ত্রিক অর্থনীতিক উন্নয়নের সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করে,, কারণ গণতন্ত্র মানে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র মানে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক মানে সমাজ গণতান্ত্রিক মানে সরকার। গণতন্ত্রের ধার্যকরা কর ধার্য করার ট্যাক্স দিয়েই একটি রাষ্ট্রের রাজস্ব গড়ে ওঠে একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করার ব্যাপক ভূমিকা পালন করে,,, রাষ্ট্রের জন্য যত উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করা হয় সব গণতন্ত্রের সরকারের ধার্য করা করের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের অভিচ্ছেদ্য অংশের অর্থনৈতিক কর্মফলের কারণে।

Q6. জলপথকে উন্নয়নের জীবনরেখা বলা হয় কেন

Ans – বিপুল পরিমাণে খনিজ তেল, আকরিক লােহা, কয়লা, ইস্পাত, রেলইঞ্জিন, ট্রাক, মােটরগাড়ি প্রভৃতি নিয়ে বিশালাকৃতি জাহাজগুলি জলপথে চলাচল করে। জলপথের এতসব সুবিধার জন্য বর্তমানে দেশে-বিদেশে বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয় জলপথ। আর এজন্যই জলপথকে অর্থনৈতিক উন্নতির জীবনরেখা বলা হয়।

Q7. সমষ্টি উন্নয়ন বলতে কী বোঝো

Ans – সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক বা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ব্লক (সংক্ষেপে ব্লক) ভারতের গ্রামস্তরের স্থানীয় প্রশাসনিক বিভাগ। ব্লকের শাসনভার ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের (বিডিও) হাতে ন্যস্ত থাকে। ১৯৫২ সালে গ্রামীণ শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসচেতনা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচি ঘোষিত হয়।

Q8. উন্নয়ন প্রশাসন কি

Ans – উন্নয়ন প্রশাসন তাকেই বলে যেখানে, যাঁরা জড়িত তাঁদের মতে, উন্নয়নের অগ্রগতির উদ্দেশ্য সাধিত হবে এমন প্রকল্প সংগঠিতভাবে কার্যকর করার প্রচেষ্টা চালানো হয়

Q9. জলবিভাজিকা উন্নয়ন কি

Ans – যে পরিকল্পনার মাধ্যমে সমগ্র নদী অববাহিকা অঞ্চলের ভূমিক্ষয়, ধস, বন্যা ও খরা প্রতিরােধ করে মাটি, জল ও বনভূমির সুষ্ঠ ব্যবহারের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র পরিবেশের উৎপাদন ও সম্পদের স্থায়ী উন্নয়ন করা যায়, তাকে জলবিভাজিক উন্নয়ন বা ব্যবস্থাপনা বলে।

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।