- বিশ্বায়ন কি
- বিশ্বায়ন কাকে বলে
- বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো
- বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ আলোচনা করো
- উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব, উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়নের প্রভাব
- বিশ্বায়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- বিশ্বায়ন ছবি
- বিশ্বায়নের কারণ ও ফলাফল, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা কর
- বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা
- FAQ | বিশ্বায়ন
বিশ্বায়ন কি
বিশ্বায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, সাংস্কৃতিক, এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি একক বিশ্ব সমাজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে।
কোল্ড ওয়ার (Cold War) সমাপ্ত হওয়ার পর, বিশ্বায়ন শব্দটি বিশ্ব অর্থনৈতিক এবং তথ্য আদান-প্রদানের দিক দিয়ে পারস্পরিক নির্ভরশীল হওয়ার বর্ণনা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক রোল্যান্ড রবার্টসন সর্বপ্রথম বিশ্বায়নকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।
বিশ্বায়ন কাকে বলে
বিশ্বায়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ধারণা, পণ্য এবং পরিষেবা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বায়নকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষকে সংযুক্ত করার একটি প্রক্রিয়া হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
সাধারণ অর্থে, বিশ্বায়ন বলতে সারা বিশ্বের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান একীকরণকে বোঝায়। এই একীকরণ আন্তর্জাতিক সীমানা জুড়ে মানুষ এবং জ্ঞানের চলাচল ছাড়াও সীমান্তের ওপারে পণ্য, পরিষেবা এবং পুঁজির চলাচলে ভুমিকা রেখেছে।
বিশ্বায়ন বিশ্বের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান আন্তঃনির্ভরতাকে বর্ণনা করে যা পণ্য, পরিষেবা, প্রযুক্তি, এবং বিনিয়োগের প্রবাহ, মানুষ এবং তথ্যের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য দ্বারা সৃষ্ট।
অ্যান্থনি গিডেনস এর মতে, ”বিশ্বায়ন বলতে বোঝায় যে আমরা সবাই ক্রমবর্ধমানভাবে এক বিশ্বে বাস করি যেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং জাতি পরস্পর নির্ভরশীল হয়।”
সমাজবিজ্ঞানী মার্টিন অ্যালব্রো এবং এলিজাবেথ কিং এর মতে, ”বিশ্বায়ন সেই সমস্ত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বিশ্বের মানুষ একটি একক বিশ্ব সমাজে অন্তর্ভুক্ত হয়।”
বিশ্বায়নের সংজ্ঞা
একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্বায়ন এর ধারণা পাল্টে গেছে। এখন বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করছেন। এখানে তার কিছু নমুনা দেওয়া হলো:
সমাজবিজ্ঞানী মার্টিন আল ব্রো এর মতে, বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি সামগ্রিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সমস্ত মানুষকে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া।
অনিতা রডিস এর মতে, অর্থনৈতিক উদারীকরণ যেমন, নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ, বেসরকারিকরণ এবং অধিকতর মুক্ত বিশ্ব বাণিজ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনেতিক ব্যবস্থার সাথে সংহতিকরণের অর্থ হচ্ছে বিশ্বায়ন।
এম. ওয়াটারস এর মতে, বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যাতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাধীনে ভৌগোলিক দূরত্ব কমে আসার বাধা অপসারণ করে এবং যাতে জনগণ পিছিয়ে যাওয়া সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়।
বিশ্বায়নের উদাহরণ
বিশ্বায়নের একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হল বিশ্বে বহুজাতিক কর্পোরেশনের অস্তিত্ব। বহুজাতিক কর্পোরেশন শব্দটি কেবল এমন একটি ব্যবসাকে বোঝায় যা একাধিক দেশে তার কার্যকলাপ পরিচালনা করে। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাকডোনাল্ডস এবং কোকাকোলা কোম্পানি।ম্যাকডোনাল্ডস একটি বহুজাতিক ফাস্ট-ফুড কর্পোরেশন যার ১২০ টি দেশ ও অঞ্চলে ৩৭,৮৫৫ টি রেস্তোরা এবং প্রায় ১.৭ মিলিয়ন কর্মচারী রয়েছে।
বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো
‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ধারণা। ইংরেজি শব্দ ‘Globalization’-এর বাংলা প্রতিশব্দ হল বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন। বিশ্বায়নের অর্থ হল পৃথিবীর নানাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বাধাকে দূর করে ব্যাবসাবাণিজ্য-সহ সমস্ত ক্ষেত্রে একক বিশ্বের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করা। অধ্যাপক রবার্টসন হলেন বিশ্বায়ন’ধারণার প্রথম প্রবর্তক। তিনিই প্রথম বিশ্বায়ন ধারণার আনুষ্ঠানিক রূপ দেন। ১৯৬০-এর দশকে বিশ্বায়ন-এর ধারণার উৎপত্তি হয় এবং ১৯৮০-র দশকে বিশ্বায়ন শব্দটি ব্যাপক প্রচারলাভ করে। এরপর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের পর এই ধারণার প্রয়ােগ শুরু হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কালটিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ও পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু নানা কারণে পুঁজিবাদী দেশগুলি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়লে লগ্নিপুঁজির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেই তার অবাধ বাণিজ্যের উপর গুরুত্ব আরােপ করে। নয়া সাম্রাজ্যবাদী লিপার শোষণমূলক চরিত্রটিকে আড়াল করার জন্য তার নতুন নাম দেওয়া হয় বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের প্রকৃতিকে প্রধানত নিম্নলিখিত তিনটি দিক থেকে আলােচনা করা যায়, যথা
[1] আর্থিক দিক: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার, বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থ ও অন্যান্য বিনিময় মাধ্যমের সঞ্চালন, এক দেশ থেকে অন্য দেশে লগ্নিপুঁজির আদানপ্রদান, বহুজাতিক অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের অবাধ স্বাধীনতা দান এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রযুক্তির আদানপ্রদান এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্য মাধ্যমের বিস্তার ও বিভিন্ন দেশের তথ্য মাধ্যমের উপর বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির প্রয়ােগ প্রভৃতি। একদিকে ক্রেতার সংখ্যা ক্রমশ কমছে, অন্যদিকে মজুত মালের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সারা বিশ্বব্যাপী দেখা দিচ্ছে আর্থিক মন্দা ও বৈষম্য। অবাধে কলকারখানা বন্ধ হওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারী উপবৃত্ত হচ্ছে একদিকে ধনিক শ্রেণির হাতে পাহাড়প্রমাণ পুঁজি জমা হওয়ায় ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং অন্যদিকে কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ হয়ে পড়ছে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর। বলাবাহুল্য, বিশ্বব্যাপী জন্ম নিচ্ছে এক উদ্বাস্তু সমস্যা যা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
[2] রাজনৈতিক দিক: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিরােধী। সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক প্রকৃতি সম্পন্ন প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের স্বার্থে পুঁজির অবাধ মুনাফা ও অবাধ লুণ্ঠনের উপর নানাপ্রকার বাধানিষেধ আরােপ করে। তবে, বিশ্বায়ন বিস্ময়করভাবে স্বায়ত্তশাসনের নানাবিধ প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে আগ্রহী। এর কারণ হল শক্তিশালী জাতি-রাষ্ট্র বিশ্বায়ন বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে দর কষাকষি করতে সক্ষম, অপরদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বায়ত্তশাসন মূলক প্রতিষ্ঠানগুলির সেই সামর্থ্য থাকে না। বৃহৎ পুঁজির নির্দেশেই তা পরিচালিত হতে বাধ্য। এইভাবে বিশ্বায়নের পাশাপাশি বিশ্বের আঞ্চলিকীকরণও ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে জোসেফ নাই এবং জন ডি জোনাহিউ তাঁদের “Governance as a Globalization World’ গ্রন্থে লিখেছেন বিশ্বায়ন এক দেশ থেকে অন্য দেশে শ্রমিকের গমনাগমন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ও সরকারের ব্যবহারযােগ্য কর (Tax) ব্যবস্থা এবং মূলধনের সচলতার সাবেকি ধারণাকে পালটে দিয়েছে। এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সারা বিশ্বের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে পৃথিবীর গুটিকয়েক দেশ। তাদের রথের ঘােড়া 201-IMF, WTO, World Bank, NATO, EEC এবং বহু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি প্রভৃতি।
[3] সাংস্কৃতিক দিক: বিশ্বায়নের লক্ষ্য হল বিশ্বব্যাপী একটি সমরূপ সংস্কৃতি গড়ে তােলা। ইনটারনেট-সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সাহায্যে এরূপ সংস্কৃতি গড়ে তােলার কাজে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্পোরেশনগুলি আত্মনিয়ােগ করে। তারা জাতি-রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক প্রবাহকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন সারাবিশ্বে Tele Electronic, Homogeneous Culture গড়ে তুলতে চায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর একটি অংশের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্য সামগ্রী, তথ্য প্রযুক্তি, ধ্যানধারণা, অন্য রাষ্ট্রের দ্বারা চালিত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষে মানুষে যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য বা ভেদাভেদ আছে তা মুছে যাচ্ছে এ কাজে সাহায্য করছে উন্নত প্রযুক্তির দান ইনটারনেট, উপগ্রহভিত্তিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক দিকের ফলে আজ দুনিয়ার খবরাখবর এক মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে।
উপসংহার: ১৯৯০-এর দশক থেকেই প্রথম ইরাক যুদ্ধ, সােভিয়েত রাশিয়ার পতন, CTBT, GATT, WTO-র সক্রিয়তা মার্কিন সেনা কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাকের উপর আক্রমণ, চিনের নীরবতা, উগ্রপন্থী কার্যকলাপ বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিভিন্ন কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপক্ষে বর্তমানে যে বিশ্বায়নের সূর্য উদিত হয়েছে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মার্কিন শক্তি নতুন উদ্যমে বিশ্বকে শাসন করার অভিপ্রায়ে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনগুলিকে মুক্ত বাজারের মুখােশে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন এক অপরিহার্য আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। বাজার, অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন থেকে কোনাে দেশ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, উন্নত দেশগুলির মােকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশসমূহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বিশ্বায়নকে কাজে লাগানাে দরকার।
বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ আলোচনা করো
বিশ্বায়ন একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া হলেও নিজেদের সুবিধার্থেই বিশ্বায়নের রূপকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা一
(১) অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন : সামগ্রিক বিচারে বিশ্বায়নের ধারণা মূলত অর্থনৈতিক। বিশ্বায়নের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ব্যক্তির সম্পদকে বিনিময় মূল্যে রূপান্তর করেছে এবং অগণিত বিমূর্ত স্বাধীনতাকে একটি নির্দিষ্ট স্বাধীনতার তকমা দিয়েছে, যার নাম হল অবাধ বাণিজ্যের স্বাধীনতা। যার প্রধান লক্ষ্য ছিল সমগ্র বিশ্ব জুড়ে সমজাতীয় বিশ্ব অর্থব্যবস্থা গড়ে তােলা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাষ্ট্রগুলির আইনের কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটল। একইসঙ্গে মূলধন ও প্রযুক্তির জোগান দিয়ে নতুন শিল্পজাত পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি করল। ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকার পরিবর্তে পশ্চিমের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ও তাদের মুখ্য পৃষ্ঠপােষক সংস্থা যথা আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পুঁজির জোগান দেওয়ার ফলে একটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করল। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল অনুন্নত রাষ্ট্রগুলি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি নীতি নির্ধারণে তাদের স্বার্থের বাহক হিসেবে কাজ করছে। এর ফলস্বরূপ আর্থিক বিশ্বায়নের স্বরূপ প্রকাশিত হচ্ছে।
(২) রাজনৈতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা বাতিল করে রাষ্ট্রকে বাজারকেন্দ্রিক সংস্থায় পরিণত করতে চায়। রাজনৈতিক বিশ্বায়ন হল উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজার দখল করা। এই প্রসঙ্গে এঙ্গেলস-এর মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে, পণ্যের অনবরত প্রসারমান বাজারের প্রয়ােজনে ধনী বুর্জোয়াদের পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। জাতীয় রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে তারা ন্যূনতম রাষ্ট্র (Minimal State)-এর ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আসলে বিশ্বায়নের মূল পরিচালক হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এর সহযােগী দোসর হল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স। এরা তাবেদারির ভূমিকা পালন করেছে। এই রাষ্ট্রগুলি জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছে এর ফলে জাতি-রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব বিপন্ন বা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাকে পুরােপুরি অকেজো করে বিশ্বের রাষ্ট্র ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় না। তাদের প্রধান লক্ষ্য হল অতীতের মতাে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির উপর নতুনভাবে ও নতুন রূপে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
(৩) সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন রূপকারদের প্রধান লক্ষ্য ছিল উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ধ্রুপদি সংস্কৃতির জগৎকে তছনছ করে দেওয়া। একইসঙ্গে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতিকে কাজে লাগিয়ে বিজাতীয় ভােগবাদী সমাজের পণ্যকে নতুন মােড়কে হাজির করা। ফলে ভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারা আজ রাষ্ট্রের গণ্ডি অতিক্রম করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সারা বিশ্বে সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠার রাস্তা সুগম হয়েছে। ইনটারনেট ও টিভির দৌলতে আজ সারা বিশ্বের মানুষ অল্প ব্যয়ে উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। একজন সমাজতত্ত্ববিদ বলেছেন যে, বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জাতীয় সংস্কৃতির ধারণা সেকেলে করে দিচ্ছে। ছেলেমেয়েদের পরনে জিন্স, পায়ে বাহারি জুতা, হাতে কোল্ড ড্রিঙ্ক, চোখে সানগ্লাস, মুখে ফাস্টফুড, কানে স্মার্ট মোবাইল ফোন পৃথিবীর যে-কোনাে দেশের যে-কোনাে জায়গার মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে। ভারতের ক্রীড়া জগৎ, সংগীত ও চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত সামগ্রী বা পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। এইভাবে ভােগবাদী সংস্কৃতি উন্নয়নশীল দেশগুলির নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে, বিশ্বায়িত সংস্কৃতির সঙ্গে আঞ্চলিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে জন্ম দিচ্ছে এক নতুন ধরনের সংস্কৃতি বা Culture I Global থেকে Glo, Local থেকে Cal = Glo-Cal. Glo – Cal Culture এবং ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ’ এই সার তত্ত্ব আজ ধুলােয় লুন্ঠিত হয়েছে।
উপসংহার: বিশ্বায়ন হল একটি ধারণা যা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে প্রভাব ফেলেছে। সারা বিশ্বে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এর কুফল দেখা দিতে শুরু করেছে। এর ফলে অতীতের মতােই ধনী ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। ফলে উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে আজ সারা বিশ্বে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে শামিল হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব, উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়নের প্রভাব
একটি উন্নয়নশীল দেশের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে। একটি উন্নয়নশীল জাতির উপর বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: বিশ্বায়ন বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য নতুন পথ খুলে দেয়, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিশ্ব অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করতে দেয়। এটি বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে, কাজের সুযোগ তৈরি করে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করে।
বাজারে প্রবেশাধিকার: বিশ্বায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলিকে বৃহত্তর বাজারের অ্যাক্সেস এবং একটি বৃহত্তর গ্রাহক বেস প্রদান করে। এটি তাদের অন্যান্য দেশে তাদের পণ্য ও পরিষেবা রপ্তানি করতে সক্ষম করে, তাদের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করে এবং বাণিজ্য বাধা হ্রাস করে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি: বিশ্বায়ন সীমানা পেরিয়ে প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের স্থানান্তরকে সহজতর করে। উন্নয়নশীল দেশগুলি উন্নত প্রযুক্তি এবং উত্পাদন পদ্ধতি গ্রহণ করে উপকৃত হতে পারে, যা তাদের উত্পাদনশীলতা, দক্ষতা এবং প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারে।
সাংস্কৃতিক বিনিময়: বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং জাতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়াকে উৎসাহিত করে। এটি ধারণা, মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যের আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করার অনুমতি দেয়।
শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়ন: বিশ্বায়ন শিক্ষাগত বিনিময় প্রোগ্রাম, বৃত্তি এবং অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলিতে অ্যাক্সেসের সুযোগ প্রদান করে। উন্নয়নশীল দেশগুলি তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে এবং একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে এই সম্পদগুলি থেকে উপকৃত হতে পারে।
স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা: বিশ্বায়ন চিকিৎসা জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের বিনিময়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলিতে অ্যাক্সেস উন্নত করতে পারে। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আরও কার্যকরভাবে স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এবং তাদের জনসংখ্যার মঙ্গল উন্নত করতে সক্ষম করে।
যাইহোক, বিশ্বায়ন চ্যালেঞ্জ এবং নেতিবাচক প্রভাবও আনতে পারে, যেমন:
অর্থনৈতিক বৈষম্য: বিশ্বায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে আয় বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশ্বায়নের সুবিধাগুলি প্রায়শই শহরাঞ্চলে বা নির্দিষ্ট শিল্পগুলিতে কেন্দ্রীভূত হয়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং গ্রামীণ এলাকাগুলিকে পিছনে ফেলে।
বৈশ্বিক বাজারের উপর নির্ভরশীলতা: উন্নয়নশীল দেশগুলি যারা রপ্তানির উপর খুব বেশি নির্ভর করে তারা বিশ্ব বাজারের অবস্থার ওঠানামার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট বা চাহিদার পরিবর্তন তাদের অর্থনীতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ক্ষতি: বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সাংস্কৃতিক সমজাতকরণ এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ ও অনুশীলনের ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
পরিবেশগত উদ্বেগ: বিশ্বায়ন শিল্পায়ন এবং সম্পদ আহরণ বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা নেতিবাচক পরিবেশগত পরিণতি হতে পারে, যেমন দূষণ, বন উজাড় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলির নীতিনির্ধারকদের জন্য যথাযথ প্রবিধান বাস্তবায়ন, শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ, অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধির প্রচার এবং সামাজিক ও পরিবেশগত উদ্বেগগুলিকে মোকাবেলা করার মাধ্যমে বিশ্বায়নের প্রভাবগুলি যত্ন সহকারে পরিচালনা করা গুরুত্বপূর্ণ।
আরো পড়তে: মানব সম্পদ কাকে বলে, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কাকে বলে, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার জনক কে
বিশ্বায়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
বিশ্বায়নের নানামুখী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। তম্মধ্যে এখানে কিছু আলোচনা করা হলো:
অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন: বিশ্বায়নের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো পণ্য, পরিষেবা, মূলধন, এবং শ্রমের অবাধ আন্তর্জাতিক প্রবাহ সৃষ্টি করা।
রাজনৈতিক বিশ্বায়ন: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি।
সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন: বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ও মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি।
পরিবেশগত বিশ্বায়ন: বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত সমস্যার প্রতি বিশ্বব্যাপী সচেতনতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি।
বিশ্বায়ন হলো একটি জটিল প্রক্রিয়া যার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতির বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে। বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত বিনিময় এবং তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্বায়ন ছবি
বিশ্বায়নের কারণ ও ফলাফল, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা কর
বিশ্বায়ন কোনো নতুন ঘটনা নয়। বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে ক্রমবর্ধমানভাবে পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। যাইহোক, সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। এটি বিভিন্ন কারণে বিস্তার লাভ করেছে যেমন উন্নত পরিবহন, উন্নত বাণিজ্য, শ্রম বৃদ্ধি, মূলধনের গতিশীলতা এবং উন্নত প্রযুক্তি।
বিশ্বায়নের কারণ
১. উন্নত পরিবহন
উন্নত পরিবহন বিশ্বব্যাপী ভ্রমণকে সহজ করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিমান ভ্রমণে একটি দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে যা সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষ এবং পণ্যের বৃহত্তর চলাচল সক্ষম করে তুলেছে। এর মাধ্যমে পরিবহনের খরচ কমেছে, বাণিজ্যকে সহজ এবং আরও দক্ষ করে তুলেছে।
২. উন্নত প্রযুক্তি
উন্নত প্রযুক্তির কারণে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ এবং তথ্য শেয়ার করা সহজ হয়েছে। কম্পিউটার, মোবাইল, স্যাটেলাইট, ডিস এন্টেনা, ইত্যাদি প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্বকে গতিশীলতা দান করেছে।
৩. বহুজাতিক কোম্পানির বৃদ্ধি
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বহুজাতিক কোম্পানির বৃদ্ধি ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী ট্রেডিং ব্লকের বৃদ্ধি যা জাতীয় বাধা হ্রাস করেছে যেমন (ইউরোপীয় ইউনিয়ন, NAFTA, ASEAN) হ্রাসকৃত শুল্ক বাধা যা বিশ্ব বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে।
৪. বৈশ্বিক বাণিজ্য চক্র
দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত যেমন একটি দেশের মন্দা বিশ্ব বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। আর্থিক ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমানভাবে বৈশ্বিক প্রকৃতির। আমেরিকার ডলারের মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পায় তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে এটির প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
৫. পুঁজির উন্নত গতিশীলতা
বিগত কয়েক দশকে, পুঁজির বাধাগুলো সাধারণভাবে হ্রাস পেয়েছে যা বিভিন্ন অর্থনীতির মধ্যে পুঁজির প্রবাহকে সহজ করে তুলেছে। এতে ফার্মগুলোর অর্থ প্রাপ্তির ক্ষমতা বেড়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের বৈশ্বিক আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধি করেছে।
৬. শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি
বিশ্বায়নের কারণে মানুষ কাজের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। ফলস্বরুপ, বৈশ্বিক রেমিট্যান্স এখন উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
৭. ইন্টারনেট
ইন্টারেটের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্য সংস্থাগুলো বিশ্বস্তরে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে। যোগাযোগ ছাড়াও ভোক্তারা অনলাইনে পণ্য অর্ডার ও বিক্রয় করতে সক্ষমতা লাভ করেছে। বিশ্বায়নের ফলে মানুষ ঘরে বসে দেশ বিদেশের পণ্য ক্রয় ও বিক্রয় করতে পারছে।
বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বায়নের ফলাফল
বিশ্বায়ন (Globalization) একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। জোসেফ স্টিগলিৎস্-এর মতে, বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল-
1) উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি
এর সহায়তায় করেছে, এর ক্ষুণ্ণ হতে মূহকে এক লতে চায় লে আখ্যা বিশ্বের মুখোমুখি সংস্কৃতি মন্তব্য জাতিক বিশ্বের সেটি অবশ্য মধ্যে উন্নত বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতির ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।) এডওয়ার্ড এস. হারমানের মতে বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী মানুষের আয়ের ফারাক ১৯৬০ সালে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ সালে ৮২:১-এ দাঁড়িয়েছে।
2) বাণিজ্য-সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ:
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্যসম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্যাবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয় কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সল্যে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।
3) বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য বিস্তার:
বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্যসম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Measures or TRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। কোনো কোনো বহুজাতিক সংস্থার বার্ষিক আয় একটি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, মার্কিনি বহুজাতিক সংস্থা জেনারেল মোটরসের বার্ষিক আয় নরওয়ের জাতীয় আয়কে অতিক্রম করেছে। আবার মার্কিনি তেল সংস্থা এক্সনের বার্ষিক আয় ভেনেজুয়েলার জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।
4) নয়া উপনিবেশিক অর্থনীতির এবং উত্তর দক্ষিণ সংঘাত:
বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং ‘উত্তর-দক্ষিণ’ সংঘাতের উদ্ভব ঘটেছে। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছে। উন্নত দেশগুলির কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ (Labour Cost)-সংক্রান্ত বিধান, অভিন্ন শ্রমিক স্বার্থসম্পর্কিত নীতিগ্রহণ, কৃষিক্ষেত্রে ভরতুকি কমানো প্রভৃতি বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তার ফলে উত্তর (উন্নত) বনাম দক্ষিণ (উন্নয়নশীল) সংঘাত তীব্রতর হয়ে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুখ হানসেনের মতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে।
5) সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি:
আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশগুলি যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস (Structural Adjustment)-এ হাত দিয়েছে তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন, ছাঁটাই, লে অফ, লক আউট, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ, জাতীয় ব্যয়ের সংকোচন ইত্যাদি পন্থা অনুসৃত হচ্ছে। কাঠামোগত এই পুনর্বিন্যাসের ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছে।
6) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংকট:
অত্যাধুনিক গণম পণ্যমূখ ভোগবাদী সংস্কৃতির আঝলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির বিশ্বায়ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঢেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকে দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় ঐতিহ্য এক সংকটের সম্মুখী হয়েছে।
বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা
বিশ্বায়ন দেশগুলিকে কম খরচে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শ্রমের অ্যাক্সেস পেতে দেয়। ফলস্বরূপ, তারা কম খরচে এমন জিনিস তৈরি করতে সক্ষম হয় যা আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাত করা যায়। বিশ্বায়নের প্রবক্তারা দাবি করেন যে এটি নিম্নলিখিতগুলি সহ বিভিন্ন উপায়ে বিশ্বকে উপকৃত করে।
বিশ্বায়নের সুবিধা
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে পণ্য ও সেবার দাম কমেছে এবং ভোক্তাদের সুবিধা হয়েছে।
বিনিয়োগ বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
প্রযুক্তিগত বিনিময় বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে প্রযুক্তিগত বিনিময় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন পণ্য ও সেবা তৈরি হয়েছে।
তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও গবেষণা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে।
দারিদ্র্য হ্রাস: বিশ্বায়নের ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।
বিশ্বায়নের অসুবিধা
অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে।
পরিবেশ দূষণ: বিশ্বায়নের ফলে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যা দেখা দিয়েছে।
সংস্কৃতি বিলুপ্তি: বিশ্বায়নের ফলে স্থানীয় সংস্কৃতি বিলুপ্তির ঝুঁকি বেড়েছে।
শ্রমিক অধিকার হ্রাস: বিশ্বায়নের ফলে শ্রমিক অধিকার হ্রাসের ঝুঁকি বেড়েছে।
রাজনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাস: বিশ্বায়নের ফলে রাজনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাসের ঝুঁকি বেড়েছে।
বিশ্বায়নের প্রভাব মূলত একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই রয়েছে। বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাবগুলিকে কাজে লাগানোর জন্য এবং নেতিবাচক প্রভাবগুলিকে হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
আরো অন্যান্য সরকারি স্কিম সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন
FAQ | বিশ্বায়ন
Q1. বিশ্বায়ন কি
Ans – বিশ্বায়ন হল বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। এটি বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশকে প্রভাবিত করে।
Q2. বিশ্বায়ন শব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেন
Ans – বিশ্বায়ন প্রত্যয়টি সর্বপ্রথম ম্যালকুম ব্যবহার করেন।
Q3. বিশ্বায়নের অর্থ কি
Ans – বিশ্বায়ন হল বিশ্বব্যাপী মানুষ, কোম্পানি এবং সরকারের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং একীকরণের প্রক্রিয়া। পরিবহন এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে 18 শতক থেকে বিশ্বায়ন ত্বরান্বিত হয়েছে । বিশ্বব্যাপী মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং ধারণা, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয়েছে।
আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন।