বহুমুখী নদী পরিকল্পনা কাকে বলে, বহুমুখী নদী পরিকল্পনা বলতে কি বোঝো
এখানে বহুমুখী পরিকল্পনা কাকে বলে, বহুমুখী নদী পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও বহুমুখী নদী পরিকল্পনার কুফল গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
যে পরিকল্পনার মাধ্যমে কোন অঞ্চলের সামগ্রিক বিকাশ সাধনের উদ্দেশ্যে অনুকূল ভূ- প্রাকৃতিক ও জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলে নদীর উপর বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে একই সাথে বহুমুখী উদ্দেশ্য পূরণ করাকে, বহুমুখী নদী পরিকল্পনা বলা হয়।
এই ধরনের পরিকল্পনা কোন অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই ভারতে স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে এই রকম অনেক বহুমুখী পরিকল্পনা গড়ে তোলা হয়েছে। ভারতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বহুমুখী পরিকল্পনা হল – a) ভাকরা নাঙ্গাল নদী পরিকল্পনা, b) দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন, c) হিরাকুদ নদী পরিকল্পনা, d) তুঙ্গ ভদ্রা বহুমুখী নদী পরিকল্পনা, e) নর্মদা নদী পরিকল্পনা প্রভৃতি।
বহুমুখী নদী পরিকল্পনার উদাহরণ
ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহুমুখী নদী পরিকল্পনা ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রূপায়ণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বহুমুখী নদী পরিকল্পনা হল :
- দামোদর নদী / উপত্যকা পরিকল্পনা
- হিমাচলের ভাকরা-নাঙ্গাল নদী উপত্যকা পরিকল্পনা এবং
- উড়িষ্যার হিরাকুদ নদী উপত্যকা পরিকল্পনা।
বহুমুখী নদী পরিকল্পনার উদ্দেশ্য গুলি কি কি
বহুমুখী নদী পরিকল্পনার উদ্দেশ্য গুলি হল:-
জলসেচের প্রসার
নদীর নিম্ন ও উচ্চ অববাহিকার অধিক পরিমাণ কৃষি জমিতে জলসেচের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নদীর উপর বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এর ফলে কৃষি জমি গুলিতে প্রয়োজন মতো জল সেচ করা সম্ভব হয় বলে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ
কোন কোন বহুমুখী নদী পরিকল্পনা গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে নিন্ম অববাহিকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা। বর্ষার অতিরিক্ত জলকে জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে ধরে রেখে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন
এইরকম বহুমুখী নদী পরিকল্পনায় বাঁধের সঞ্চিত জলকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর পরিমাণে জলবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হয়ে থাকে। যা উক্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ও শিল্পের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করে।
জলের সরবরাহ
বহুমুখী নদী পরিকল্পনা জলাধারে সঞ্চিত জলকে অনেক সময় পার্শ্ববর্তী জনবসতি ও শহরগুলি তে সরবরাহের মাধ্যমে জলের চাহিদা পূরণ করা হয়।
বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী তে সারা বছর ধরে তেমনভাবে জল না থাকায় শুষ্ক অঞ্চল গুলিকে যেখানে নলকূপ সেচ বা সেচ তেমন সহজলভ্য নয় এবং জল সেচের মাধ্যমে হিসেবে নদী খাল বিল প্রধানত ব্যবহার করা হয়, সেখানকার নদী গুলিতে বহুমুখী নদী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে বর্ষার সময় বৃষ্টি অতিরিক্ত জল কে জলাধার স্থাপন করে জলাধার গুলিতে সঞ্চয় করে রাখা যায় এবং বছরের পরবর্তী সময়ে সেই জল অল্প অল্প করে জলাধার থেকে ছেড়ে দিয়ে সারা বছর ধরে ওই জলের সাহায্যে জল সেচ করা যায়।
মৎস্য সংগ্রহ
বাঁধের সঞ্চিত সঞ্চিত জলে মৎস্য শিকারের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়।
জলপথের বিকাশ
বহুমুখী পরিকল্পনায় অনেক সময় জলপথ ব্যবস্থার বিকাশ ঘটিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো হয়।
পর্যটন শিল্পের বিকাশ
বহুমুখী নদী পরিকল্পনা কে কেন্দ্র করে অনেক সময় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটতে দেখা যায়।
শিল্পের বিকাশ
অনুকূল জলবায়ু ও পরিবেশ যুক্ত অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্প বিকাশের প্রয়োজনীয়তা সস্তা জলবিদ্যুৎ, স্বচ্ছ জল, উন্নত জলপথ ও প্রচুর পরিমাণে কৃষি জাতীয় কাঁচামালের যোগান শিল্পের বিকাশে যথেষ্ট সাহায্য করে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
এই পরিকল্পনাগুলি কে কেন্দ্র করে প্রচুর পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। যেমন – প্রকল্পটির বাস্তবায়ন, কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি, শিল্পের বিকাশ প্রভৃতি জন্য প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
মৎস্য চাষ
বহুমুখী নদী পরিকল্পনায় সৃষ্ট জলাধারগুলিতে মাঝে মাঝে মৎস্য চাষও করা হয়।
পর্যটন কেন্দ্র
বহুমুখী নদী পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা। বহুমুখী নদী পরিকল্পনা যেসব জলাধারগুলো তৈরি করা হয় সেগুলির নৈসর্গিক দৃশ্যের জন্য অনেক পর্যটকই বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন জলাশয় গুলি প্রত্যক্ষ করার জন্য। এভাবে রিজাল আসা দিনগুলি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
বহুমুখী নদী পরিকল্পনার কুফল বা সমস্যা
বহুমুখী নদী পরিকল্পনা যেহেতু একটি মাঝারি আকৃতির পরিকল্পনা যা একটি, দুটি বা তিনটি রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই ধরনের বহুমুখী পরিকল্পনা উক্ত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে নানা রূপ বিপরীত মুখী প্রভাব ফেলে থাকে। বহুমুখী নদী পরিকল্পনার নিম্নলিখিত কুফল বা অসুবিধা লক্ষ্য করা যায়।
A) অরণ্য ও বন্য প্রাণীর বিলোপ – বহুমুখী নদী পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য অনেক সময় নদী অববাহিকা অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ অরণ্য চ্ছেদন করা। ফলে একদিকে যেমন অরণ্যের পরিমাণ হ্রাস পায়, অন্যদিকে বাসস্থানের অভাবে অনেক বন্য প্রাণী চির তরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
B) নদীর নিম্ন অববাহিকায় জলের পরিমাণ হ্রাস – জলাধার বা বাঁধ গুলি সাধারণত নদীর উপরের দিকে গড়ে তোলা হয় বলে, নদীর নিম্ন অংশে জলের পরিমাণ হ্রাস পায়, নদী তার ক্ষয় করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ও নদী ক্রমশ তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে।
C) জলজ প্রাণীর উপর প্রভাব – বাঁধের নিচের অংশে তেমন জলপ্রবাহ থাকে না বলে, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী রা জলের সঙ্গে বাহিত পুষ্টি মৌল পায় না। ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
D) বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধি – বন্যা নিয়ন্ত্রণ বহুমুখী পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও অনেক সময় এই পরিকল্পনার জন্যই নদীর নিম্ন ও ঊর্ধ্ব অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যেমন – বর্ষা কালে বৃষ্টির অতিরিক্ত জল ধরে রাখতে না পেরে বাঁধ গুলি থেকে প্রচুর পরিমাণ ছেড়ে দেওয়ার ফলে নিম্ন অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আবার বাঁধের উপরের অংশে সঞ্চিত জলের ফলে ঊর্ধ্ব অববাহিকার বেশ কিছু অংশ প্লাবিত হয়ে থাকে।
E) ভূমিকম্পের সম্ভাবনা – অনেক সময় জলাধারে সঞ্চিত জলরাশির প্রচণ্ড চাপে বাঁধের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন – 1967 সালে মহারাষ্ট্রের কয়না জলাধারের চাপে কয়ণা অঞ্চলে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
F) বাস্তু ত্যাগ ও পূনর্বাসন মূলক সমস্যা – এই ধরনের বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্বে নদীর নিম্ন অংশে বসবাসকারী মানুষদের সরানো হয়, ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষের বাস্তু ত্যাগ ঘটে এবং পরবর্তী কালে এই সব মানুষদের পূনর্বাসন মূলক নানা রূপ সমস্যার সৃষ্টি হয়।
G) বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিবাদ – বহুমুখী পরিকল্পনা গুলি যেহেতু অনেক সময় দুই তিনটি রাজ্যের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে ওঠে, তাই এই রাজ্য গুলির মধ্যে পরিকল্পনা রূপায়ণের ব্যয়, জলের পরিমাণ প্রভৃতি নানা দিক নিয়ে বিবাদের সূচনা হয়।
ভারতের বৃহত্তম বহুমুখী নদী পরিকল্পনা কোনটি, ভারতের বৃহত্তম বহুমুখী নদী পরিকল্পনা
ভারতের বৃহত্তম বহুমুখী নদী পরিকল্পনা – ভাকরা-নাগাল পরিকল্পনা।
ভারতের বিভিন্ন বহুমুখী নদী পরিকল্পনার মধ্যে ভাকরা নাঙ্গাল পরিকল্পনা সর্ববৃহৎ নদী পরিকল্পনা । পাঞ্জাব , হরিয়ানা ও রাজস্থান সরকারের মিলিত প্রচেষ্টায় এই পরিকল্পনা গৃহীত হয় । এই পরিকল্পনায় পাঞ্জাব , হরিয়ানা ও রাজস্থানের শুষ্ক অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টির দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয় , কারণ এই সকল রাজ্যে কয়লা বা খনিজতৈলের একান্ত অভাব লক্ষ্যনীয় । এই জলবিদ্যুৎ এই অঞ্চলে বিশেষত পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় দ্রুত শিল্পবিকাশে এবং কৃষিকার্যে যথেষ্ট সহায়তা করেছে ।
উদ্দেশ্যঃ ভাকরা নাঙ্গাল পরিকল্পনা – র উদ্দেশ্যগুলি নিম্নরূপ
- বাঁধ নির্মাণঃ এই পরিকল্পনায় পাঞ্জাবের শতদ্রু নদীতে ভাকরা ও নাঙ্গাল নামক দুইটি স্থানে দুইটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে । নিচে এই দুটি বাঁধ সম্পর্কে আলোচনা করা হল
- ভাকরা বাঁধঃ রােপার থেকে প্রায় ৮০ কিলােমিটার উত্তরে শতদ্রু নদীর উপর প্রায় ৫১৮ মিটার দীর্ঘ এবং প্রায় ২২৬ মিটার উচ্চ এই বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে । এটি পৃথিবীর উচ্চতম বাঁধ । ভাকরা বাঁধের পশ্চাতের জলাধারের জলধারণ ক্ষমতা ৭.৪ লক্ষ হেক্টর মিটার ।
- নাঙ্গাল বাঁধঃ ভাকরা বাঁধের প্রায় ১৩ কিলােমিটার দক্ষিণে যেখানে শতদ্রু নদী শিবালিক পৰ্বতকে অতিক্রম করে সমভূমিতে প্রবেশ করেছে সেখানে নাঙ্গাল বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে । এই বাঁধটি প্রায় ২৮৭ মিটার দীর্ঘ এবং ২৯ মিটার উঁচু । নাঙ্গাল বাঁধের জলাধারের জলধারণ ক্ষমতা হল প্রায় ২,৯৭৬ হেক্টর মিটার ।
- জলবিদ্যুৎ উৎপাদনঃ এই পরিকল্পনায় ভাকরা , কোটলা ও গাঙ্গুওয়ালে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে । ভাকরা বাঁধের বামতীরের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৫ টি ৯০ মেগাওয়াট এবং ২ টি ২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিট স্থাপিত হয়েছে । নাঙ্গাল হাইডেল ক্যানেলের উপর গাঙ্গুওয়াল ও কোটলায় ২৯ মেগাওয়াট ক্ষমতাযুক্ত একটি করে ইউনিট স্থাপিত হয়েছে । পরবর্তীকালে ভাকরার দক্ষিণ তীরে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হওয়ায় বিদ্যুতের মোট উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাইয়া ১,২০৪ মেগাওয়াট হয়েছে ( ভাকরা – নাগাল প্রকল্পে ৬০৪ মেগাওয়াট এবং ভাকরা দক্ষিণ তীরে বিদ্যুৎ প্রকল্পে ৬০০ মেগাওয়াট ) ।
- জলসেচ ও খাল খননঃ ভাকরা বাঁধ থেকে ভাকরা প্রধান খাল ও ভাকরা প্রধান শাখাখাল এবং নাঙ্গাল বাঁধ থেকে ৬৪ কিলােমিটার দীর্ঘ একটি সুড়ঙ্গখাল কাটা হয়েছে । এই পরিকল্পনায় মােট প্রায় ১,১০০ কিঃ মিঃ খাল ও ৩,৪০০ কিঃ মিঃ শাখাখাল কাটা হয়েছে । খালদুটির মাধ্যমে পাঞ্জাব , হরিয়ানা ও রাজস্থানের কৃষিক্ষেত্রে সেচের জল নিয়ে যাওয়া হয় । এই খালগুলি প্রায় ২৭.৪ লক্ষ হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত । এই খাল মাধ্যমে বর্তমানে ১৪.৬ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমিতে জলসেচ করা সম্ভব হয়েছে ।
- উপকৃত অঞ্চলঃ এই পরিকল্পনার ফলে সামগ্রিকভাবে পাঞ্জাব , হরিয়ানা ও রাজস্থান বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে । এই সকল অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে কৃষির উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি হয়েছে । খাদ্যশস্য , তুলা , ইক্ষু , তৈলবীজ প্রভৃতির উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে । এই পরিকল্পনায় যে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে তা বিভিন্ন শিল্পকর্মে , সেচকার্যে , বৈদ্যুতিক নলকূপ থেজে জল তুলতে এবং পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎসংযোগ কার্যে ব্যবহার করা হয় । কেবল পাঞ্জাব , হরিয়ানা ও রাজস্থানেই নয় , এই বিদ্যুৎ সুদূর দিল্লী অঞ্চলেও সরবরাহ করা হয় । এই পরিকল্পনার ফলে এই অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রেও যথেষ্ট উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে ।
নদীমাতৃক সভ্যতা কাকে বলে
নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়ে উঠলে প্রযােজন হয় স্থায়ী বাসস্থানের। বিভিন্ন কারণে মানুষ নদীর তীরে বা নদী উপত্যকাকে বসবাসের আদর্শ স্থান বলে মনে করেছিল, তাই সেখানে বসবাস শুরু করে। ক্রমশ নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠে সভ্যতা। একেই বলে নদীমাতৃক সভ্যতা।
যেমন : সিন্ধু নদীর উপত্যকায় হরপ্পা সভ্যতা, নীলনদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসােপটেমিয়া ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, ইয়াংসিকিয়াং ও হােয়াং হাে নদীর তীরে চৈনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে বিভিন্ন নদীমাতৃক সভ্যতা গুলির বিকাশ ঘটেছিল।
যে দেশ সুপ্রবাহিনী নদীদের দাক্ষিণ্যে পুষ্ট তাকে নদীমাতৃক বলা হয়৷ ভারতবর্ষের ভূভাগের উপর দিয়ে অন্তত আটশো ছোটোবড়ো নদী বয়ে যাচ্ছে৷ সহজেই বোঝা যায় এ দেশকে প্রাচীনকাল থেকে কেন ‘নদীমাতৃক’ বলে৷ প্রাচীন কাল থেকে এই নদী তটেই ভারতের সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছে ।
ভারতকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয় কেন
গঙ্গা , ব্রহ্মপুত্র , সিন্ধু , গােদাবরী , কৃষ্ণা , কাবেরী , নর্মদা , তাপী প্রভৃতি বড় বড় নদনদী ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অংশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে অসংখ্য ছােট ছােট নদ – নদী । ভারতের নদীগুলি বছরে গড়ে ১৮৬৯০০ কোটি ঘনমিটার জল বহন করে ( প্রধান নদীগুলি ৮৫ % , মাঝারি নদীগুলি ৭ % ও ছােটো নদীগুলি ৪ % এবং অন্যান্য জলধারা ৪ % জল বহন করে । নিচে ভারতকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয় কেন তা আলোচনা করা হল
- ছােট বড় মিলিয়ে অগণিত নদ – নদী সুদূর অতীত থেকে ভারতবাসীর জীবনধারার ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে । শুধু হরপ্পা – মহেঞ্জোদাড়াের মতাে প্রাচীন সভ্যতা ( সিন্ধুনদ তীরবর্তী ) নয় বা এলাহাবাদ , বারাণসীর মতাে প্রাচীন ধর্মস্থান ( গঙ্গা তীরবর্তী ) নয় , আধুনিক ভারতেরও অধিকাংশ শহর , নগর , জনপদ গড়ে উঠেছে কোনও না কোনও নদীর তীরে ।
- জীবিকার ক্ষেত্রে দেখা যায় , বর্তমানে দেশের শতকরা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন অধিবাসী কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল । দেশের খাদ্য – বস্ত্রের উৎপাদন এবং অর্থনীতিও বহুলাংশে কৃষিনির্ভর । এত গুরুত্বপূর্ণ যে কৃষিকাজ , তার অধিকাংশ কেন্দ্রীভূত দেশের বিস্তীর্ণ নদী উপত্যকাগুলিতে ।
- সকল শিল্পের মেরুদণ্ড হিসাবে পরিচিত লৌহ – ইস্পাত শিল্প পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয় , যে কারণে নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই লৌহ – ইস্পাত শিল্প গড়ে ওঠে । এছাড়াও, অন্যান্য কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প যেমন – কার্পাস বয়ন শিল্প , চিনি শিল্প , পাট শিল্প প্রভৃতি কৃষিভিত্তিক শিল্পগুলিও পরােক্ষভাবে নদীর ওপর নির্ভরশীল ।
- দেশের জলসেচ ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ভারতের নদ – নদীগুলি । ভারত মৌসুমি জলবায়ুর দেশ হওয়ায় বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা ও সীমাবদ্ধতার কারণে বিকল্প হিসাবে নদ – নদী থেকে সরাসরি বা খালের মাধ্যমে দেশের জলসেচ ব্যবস্থা পরিচালিত হয় ।
- ভারতের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল উৎস হল নদ – নদীগুলি । উত্তর ভারতের বরফগলা জলে পুষ্ট নদ – নদীগুলির উচ্চ প্রবাহ থেকে এবং দক্ষিণ ভারতের খরস্রোতা নদ – নদীগুলি থেকে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ ভারতের শক্তি চাহিদার এক বিরাট অংশ পূরণ করে থাকে ।
- অভ্যন্তরীণ সুলভ জলপথে ভারতের পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালিত হয় । উত্তর ভারতের নাব্য নদীপথগুলি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে । কেরালায় জলপথে পরিবহন তাৎপর্যপূর্ণ ।
- পানীয় জলের যােগানের এক বৃহৎ অংশ আসে ভারতের নদ – নদীগুলি থেকে । নদী উপকূলস্থ পৌরবসতিগুলিতে পার্শ্ববর্তী নদী থেকে জলসংগ্রহ করে তা পরিশ্রুত করে লোকালয়ে সরবরাহ করা হয়
- ভারতের জীবনধারা এ দেশের নদ – নদীগুলির সঙ্গে এতই ওতপ্রােতভাবে জড়িত যে নদ – নদীগুলির বুকে কান পাতলে যেন ভারতেরই হৃদয়ের স্পন্দন শােনা যাবে । নদ – নদীগুলি যেন মায়ের মতাে সন্তানস্নেহে ভারতীয়দের লালন – পালন করে চলেছে , ভারতীয়দের জীবনধারাকে পরিপুষ্ট করে চলেছে । এজন্যই ভারতকে নদীমাতৃক দেশ বলে ।
নদীমাতৃক সভ্যতা গড়ে ওঠার কারণ
বিভিন্ন নদীর তীরে প্রাচীন সভ্যতাগুলি গড়ে ওঠার পেছনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল
(১) অনুকূল আবহাওয়া: নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের আবহাওয়া নাতিশীতােষ্ণ হয়। এই আরামদায়ক আবহাওয়ার অন্য প্রাচীন মানুষ নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে।
(২) পানীয় জলের সুবিধা – প্রাচীনকালে আদিম মানুষের কাছে পানীয় জলের একমাত্র উৎস ছিল নদীনালা বা হ্রদের জল। পানীয় জলের সুবিধার জন্যই মানুষ নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
(৩) উর্বর জমি – নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের জমি খুব উর্বর হয়। কারণ বর্ষাকালে বন্যার সময় নদীর দুকূল প্লাবিত হয়। জমিতে প্রচুর পলি পড়ে। এই পলিমাটিতে ভালাে ফসল হয়। শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আদিম মানুষ নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে।
(৪) জলসেচের সুবিধা – কৃষিকাজের জন্য জলসেচের দরকার হয়। নদীতে বাঁধ দিয়ে নদী থেকে খাল কেটে নদীর জল কৃষি জমিতে জলসেচ করা যায়। এর ফলে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
(৫) পশুপালন – নদীর তীরবর্তী অঞ্চল উর্বর হওয়ার ফলে প্রচুর ঘাস জন্মায়। গৃহপালিত পশুর প্রধান খাদ্য হল ঘাস। তাই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গৃহপালিত পশুর খাদ্যের অভাব ছিল লা। তাই পশুচারণের সুবিধার জন্য তারা নদী তীরবর্তী অঞ্চলকে বেছে নিয়েছিল।
(৬) মৎস্য শিকার – মাংসের পর মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য ছিল মাছ। আবার নদী ও হ্রদে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। মাছ শিকারের সুবিধার জন্যই মানুষ নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। যা ক্রমশই নগর কেন্দ্রিক সভ্যতায় পরিণত হয়।
(৭) যােগাযােগ ও পরিবহন – আদিম মানুষের কাছে স্থলপথে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া ও পণ্য পরিবহন খুবই কষ্টকর ছিল। সেই তুলনায় জলপথ ছিল সহজতর মাধ্যম। নৌকা বা ডিঙির সাহায্যে মানুষ একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত বা পণ্য পরিবহন করত। যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের সুবিধার জন্যই আদিম মানুষ নদী তীরবর্তী অঞ্চলকেই বসবাসের জন্য নির্বাচন করে।
আরো অন্যান্য সরকারি স্কিম সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন
FAQ | বহুমুখী নদী পরিকল্পনা
Q1. বহুমুখী নদী পরিকল্পনা কি
Ans – যে পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ পার্বত্য বা পাহাড়ি অঞ্চলে নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে নদী উপত্যকা এবং অববাহিকা অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন মৎস্যচাষ পানীয় জল সরবরাহ ইত্যাদি প্রভূত সুবিধা লাভ করা যায় এবং সর্বোপরি নদী অববাহিকা অঞ্চলের মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যায় তাকে বহুমুখী নদী পরিকল্পনা বলা হয়ে থাকে।
Q2. পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বহুমুখী নদী পরিকল্পনা টির নাম লেখ
Ans – পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বহুমুখী নদী পরিকল্পনা টি হল দামোদর নদী উপত্যকা পরিকল্পনা।
Q3. নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে
Ans – যে দেশ সুপ্রবাহিনী নদীদের দাক্ষিণ্যে পুষ্ট তাকে নদীমাতৃক বলা হয়৷ ভারতবর্ষের ভূভাগের উপর দিয়ে অন্তত আটশো ছোটোবড়ো নদী বয়ে যাচ্ছে৷ সহজেই বোঝা যায় এ দেশকে প্রাচীনকাল থেকে কেন ‘নদীমাতৃক’ বলে৷ প্রাচীন কাল থেকে এই নদী তটেই ভারতের সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছে ।
আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন।