দ্বিজাতি তত্ত্ব
বিংশ শতকের শুরু থেকে, ভারতের দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় (হিন্দু-মুসলিম) এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। গোঁড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনা সাম্প্রদায়িকতার বিষফোড় ঘনীভূত করতে থাকে। মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দাবি ও আন্দোলন সর্বদা হিন্দু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হতে থাকে।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর, কংগ্রেস এককভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করে। ফলে, কংগ্রেসের শাসন এবং হিন্দু আধিপত্যের কারণে মুসলমানদের স্বার্থে চরম আঘাত আসে। এ পরিস্থিতিতে, ১৯৪০ সালে পাকিস্তানের লাহোরে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর বিখ্যাত দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রকাশ করে।
দ্বিজাতি তত্ত্ব কি
‘দ্বিজাতি’ বলতে বুঝায় দুটি জাতি এবং দুটি জাতি সম্পর্কিত তত্ত্বই হচ্ছে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’। আর ভারতবর্ষে এ তত্ত্বের প্রবক্তা হচ্ছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ভারতে বসবাসরত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক কোনদিনও ভালো ছিল না। যদিও এ উভয় সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উপলব্ধি করেন যে, কংগ্রেসের ছায়াতলে মুসলমানদের ভাগ্যের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
তাই তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ে তৎপর হয়ে উঠেন এবং মুসলমানরা যে একটি স্বতন্ত্র জাতি তা প্রচার করতে থাকেন। তিনি প্রচার করেন যে, হিন্দু ও মুসলমান শুধু ধর্মের দিক হতেই পৃথক নয় বরং উভয়ের সামাজিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও ভিন্ন ধরনের।
তাই এ দুই জাতির মিলনে কখনো একটি জাতিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। তাঁর ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে ১৯৪০ সালের ২২ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ২৩ তম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি তাঁর ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ বা Two nation theory’ উত্থাপন করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, “যে কোন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মুসলমানরা একটা জাতি।
তাই তাদের প্রয়োজন একটা পৃথক আবাসভূমি, একটা ভূখণ্ডের এবং একটা রাষ্ট্রের।” (By any international standard the Muslims are a nation. So they are in need of a separate homeland, a territory and a state) (সূত্র : ইয়াসমিন আহমেদ ও রাখী বর্মন, ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, পৃ. ২৫৪) এ ঘোষণা ঐতিহাসিক ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ নামে খ্যাত।
দ্বিজাতি তত্ত্ব কাকে বলে
দ্বিজাতি তত্ত্ব হল এমন একটি মতাদর্শ যেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রাথমিকভাবে কেবলমাত্র তাদের ধর্মের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমান এবং হিন্দু দুটি স্বতন্ত্র জাতীয়তার পরিচয় দেয়া হয়েছে, এবং যেখানে ভাষা, বর্ণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্টের তুলনায় ধর্মকে বেশি প্রধান্য দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলন এবং ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের অন্যতম কারণ ছিলো এই দ্বিজাতি তত্ত্ব।
দ্বিজাতি তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য
দ্বিজাতি তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্মে তা বর্ণনা করা হল।
- মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব
- হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দের সমাধান
- লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি
- ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ
- সাম্প্রদায়িকতা বিলুপ্তি
- দুটি স্বতন্ত্র এবং পৃথক জাতি সৃষ্টি
- মুসলমানদের ধর্মীয় এক্য বৃদ্ধি
- স্বতন্ত্র আবাসভূমি
- মুসলমানদের জাতীয় নেতৃত্বের বিকাশ
দ্বিজাতি তত্ত্ব বলতে কি বুঝ
দ্বিজাতি তত্ত্ব উত্থাপনের মূল কারণ ছিল তৎকালীন সময়ে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বেশকিছু সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং অসমতা। এই তত্ত্ব অনুসারে, ভারতীয় মুসলমান এবং ভারতীয় হিন্দু দুটি পৃথক জাতি। তাদের নিজস্ব রীতিনীতি, ধর্ম এবং ঐতিহ্য রয়েছে। তাই, সামাজিক এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের বাইরে মুসলমানদের নিজস্ব রাষ্ট্র থাকা উচিত।
এর প্রেক্ষিতে, ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে হিন্দু এবং মুসলমানকে দুটি আলাদা জাতিতে তথা রাষ্ট্রে বিভক্ত করার জন্য দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা করা হয়।
১৯৪০ সালের ২২-২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। উক্ত ঘোষণায় তিনি বলেন, ভারতের সমস্যা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে নয়, দুই জাতির মধ্যে।
তারঁ মতে যেহেতু হিন্দু-মুসলিম দুটি স্বতন্ত্র এবং পৃথক জাতি, তাই তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করে দেয়াই সমাধান হবে। লাহোর অধিবেশনে জিল্লাহ মুসলমানদের পৃথত জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এরূপ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের অধিবেশনে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি স্থাপনের রূপরেখা সম্বলিত একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
এর মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু এবং মুসলমানকে দুটি স্বতন্ত্র জাতীয়তার পরিচয় দেয়া হয়েছে, যেখানে ভাষা, বর্ণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্টের তুলনায় ধর্মকে বেশি প্রধান্য দেয়া হয়। ফলস্বরুপ, পাকিস্তান আন্দোলন এবং ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ হয়।
অবশেষে, ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট, মুসলিম লীগ একটি স্বাধীন পাকিস্তানের দাবি উত্থাপন করে। ফলে, কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বে, বিহার, পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়।
১৯৪৭ সালে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন একটি স্বাধীন পাকিস্তানের জন্য মুসলিম লীগের দাবির সাথে একমত হন। অবশেষে, ৩ জুন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতকে দুটি রাষ্ট্রে (ভারত ও পাকিস্তান) বিভক্ত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়।
দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা কে
দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ খানকে দ্বি-জাতি তত্ত্বের পথিকৃৎ হিসেবে ব্যাপকভাবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তবে, দ্বিজাতি তত্ত্বের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ায় এবং ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয়তা সংজ্ঞায়িত করার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবর্তক বলা হয়।
দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক কে
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দিজাতি তত্ত্বের প্রবর্তক।
ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানকে পৃথক আবাসভূমিসহ দুটি ভাগে বিভক্ত করার জন্য মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়, ইতিহাসে তা দ্বিজাতি তত্ত্ব (Two nation theory) নামে পরিচিত। দ্বিজাতি অর্থ দুটি জাতি।
দ্বিজাতি তত্ত্ব হল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের একটি আদর্শ যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতার পর ভারতীয় উপমহাদেশকে দুটি আলাদা জাতিতে বিভক্ত করেছিল।
দ্বি জাতি তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর
ভারতবর্ষে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালের নির্বাচন এ পরে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে কংগ্রেস এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিম লীগের মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। কংগ্রেসের শাসনাধীন প্রদেশ সূমহ মুসলমাদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চলতে থাকে। এর ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরূপ পরিস্তিথিতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার এই দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা করেন। তিনি ধর্মীয় দিক কে প্রাধান্য দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানকে দুটি পৃথক জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এ ভাষণে জিন্নাহ বলেন, ‘যে কোন আন্তর্জাতিক মানদন্ডে মুসলমানরা একটি জাতি। তাই তাদের একটি পৃথক আবাসভূমি প্রয়োজন, প্রয়োজন একটি ভূখণ্ডের এবং একটা রাষ্ট্রের। জিন্নাহ তিনি তার দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তি পেশ করেন-
- ১. ভারত শুদু একটি দেশ নয় একটি উপমহাদেশ।
- ২. যে ভিত্তিতে এ মহাদেশে হিন্দুরা ও একটি জাতি , সে ভিত্তিতে মুসলমানরাও একটি জাতি।
- ৩. মুসলমানদের ভাষা , শিল্পকলা , সাহিত্য ,ও তাদের নৈতিক বিধান ,আচার ব্যবহার, ইতিহাস হিন্দুদের থেকে ভিন্ন।
- ৪. হিন্দু-মুসলিম জনগণঅনুপেরনা লাভ করে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে। অতএব আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা আমরা একটি জাতি জিন্নাহর দ্বিজাতি।
জিন্নার এ তত্ত্বই দ্বিজাতি তত্ত্ব।
তিনি আরো বলেন, আমরা দৃঢ় ভাবে মনে করি জাতিসত্তার যেকোনো সংখ্যা বিচারে ভারতের হিন্দু মুসলমান দুটি ভিন্ন প্রজাতি। ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র, সংস্কৃতি, সভ্যতা, রীতিনীতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য এবং অভিন্ন জীবন পদ্ধতি। ” এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর যে হিন্দু-মুসলমান ইতিহাসের স্বতন্ত্র উৎসাহ অনুপ্রেরণা লাভ করে থাকে তাদের মহাকাব্য ভিন্ন তাদের বীর সেনানী গণতন্ত্র এবং যে কোন বিষয়ে ভিন্ন একজনের কাছে যা পবিত্র অন্যজনের কাছে তা হাস্যকর।” ” তিনি আরও বলেন, আমরা স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে ইচ্ছা পোষণ করি। “
দ্বি জাতি তত্ত্বের গুরুত্ব
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব’ ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল। তাঁর এ কৌশলের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সমগ্র মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা।
কেননা অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা যেমন অসম্ভব ছিল, তেমনি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাও সম্ভব ছিল না। তাই এ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এবং মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি গঠনের লক্ষ্যে জিন্নাহ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব’ উত্থাপন ও প্রচার করেন। আর মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধতার কারণেই এক সময় ভারত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং মুসলমানগণ পাকিস্তান নামে নতুন রাষ্ট্র গঠন করে। সুতরাং সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে জিন্নাহর “দ্বিজাতিতত্ত্ব’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরো অন্যান্য প্রশ্নোত্তরের সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন
FAQ | দ্বিজাতি তত্ত্ব
Q1. দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল কথা কি
Ans – হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। এই তত্ত্বই দ্বিজাতি তত্ত্ব নামে পরিচিত।
Q2. দ্বি জাতি তত্ত্বের তাৎপর্য
Ans – ভারত দেশটি তিন টুকরো করা তত্ত্বকে দ্বিজাতি তত্ত্ব বলা হয়ে থাকে। এই দ্বিজাতি তত্তের মূল কারিগর মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ।
আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন।