সবুজ বিপ্লব কাকে বলে, সবুজ বিপ্লবের জনক কে, সবুজ বিপ্লব বলতে কী বোঝো

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

সবুজ বিপ্লব কাকে বলে

১৯৬০ -৮০ এর দশকে সারা বিশ্বের কৃষিক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি, উন্নত সার, বীজ ও উদ্ভাবনের কারণে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। আর এটিকেই সবুজ বিপ্লব বলে।

ভারতবর্ষে স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা যেত। তার অন্যতম প্রধান কারণ হল ভারতে পুরনো পদ্ধতিতে কৃষিকাজ । তাই ফসলের উৎপাদন ছিল খুব কম যা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম ছিল না। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ভারত সরকার কে একটা বড়ো অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো অর্থাৎ খাদ্যের জন্য পরনির্ভরশীল ছিল।

তাই ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা যায় এবং এই আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন অনেকটাই বৃদ্ধি পায়, এটিই ভারতের ইতিহাসে সবুজ বিপ্লব নামে পরিচিত।

সবুজ বিপ্লবের সংজ্ঞা

ভারতবর্ষে ১৯৬০ এর দশকে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, জলসেচ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় যার ফলস্বরূপ ফসলের উৎপাদন অত্যাধিক পরিমানে বৃদ্ধি পায়, যাকে সবুজ বিপ্লব বলে। সবুজ বিপ্লবের প্রধান ফসল হল গম ও ধান।ভারতবর্ষে সবুজ বিপ্লব প্রথম দেখা যায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে।

  • উচ্চফলনশীল বীজের আবিষ্কারক নরম্যান বোরলাঙ কে সবুজ বিপ্লবের জনক বলা হয়।
  • সবুজ বিপ্লব শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন উইলিয়াম গ্যাড ১৯৬৮ সালে।
  • ভারতে সবুজ বিপ্লবের জনক বলা হয় এম এস স্বামীনাথান কে।

সবুজ বিপ্লব বলতে কী বোঝো

সবুজ বিপ্লব (Green Revolution) বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে উচ্চ ফলনশীল বীজ, সার এবং সেচের পানি ব্যবহারের মাধ্যমে গম, ধান, ভুট্টা প্রভৃতির উৎপাদনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অতি দ্রুত যে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়েছে তাকে ‘সবুজ বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

এখানে বিপ্লব শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে দ্রুত পরিবর্তন অর্থে।

ষাটের দশকের শেষে ভারতীয় কৃষির বহুগুণ উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনকে সবুজ বিপ্লব বলে।

ভারতবর্ষ হল কৃষি প্রধান দেশ। ভারতের বেশিরভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বেড়েছিল খাদ্যশষ‍্যের চাহিদা। কিন্তু প্রাচীন পদ্ধতির চাষাবাদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষিজমির অভাব ও দুর্বল মানবিক উপাদান প্রভৃতির কারণে 1960 সাল পযর্ন্ত ভারতীয় কৃষি তেমনভাবে উন্নতি করতে পারে নি। 1963 সালে কৃষিবিজ্ঞানী বোরলগের নেতৃত্বে ভারতীয় কৃষির আমূল পরিবর্তন ঘটে। কৃষির সার্বিক অগ্রগতির জন্য ষাটের দশকের শেষভাগে (1966–67) কতগুলি কর্মসূচি নেওয়া হয়।

সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি

  • 1. কৃষিতে উচ্চফলনশীল বীজের ব‍্যবহার।
  • 2. আধুনিক যন্ত্রপাতির ব‍্যবহার।
  • 3. নিয়ন্ত্রিত জলসেচের ব‍্যবস্থা।
  • 4. সার ও কীটনাশকের প্রয়োগ।
  • 5. কৃষি জমির ভিত্তিতে কৃষকদের ঋণদান।
  • 6. পতিত জমি উদ্ধার ও ভূমি সংস্করণের ব‍্যবস্থা।
  • 7. কৃষকদের পরামর্শ দান প্রভৃতি।

উপরিউক্ত কর্মসূচি দেওয়া হয় ও বাস্তবায়ন করা হয়। এর ফলে ভারতীয় কৃষিতে ফসল উৎদানের হার অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়। এই সবুজ বিপ্লব বিশেষত গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সবুজ বিপ্লবের উদ্দেশ্য

সবুজ বিপ্লবের সার্থক রূপায়ণের জন্য যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা হয়েছে তাদেরকে প্রধান ও অপ্রধান এই দুই ভা ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে।

প্রধান পদক্ষেপগুলি হল

  • উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার।
  • জলসেচ ব্যবস্থার প্রসার।
  • পর্যাপ্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার।
  • উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার।

অপ্রধান পদক্ষেপগুলি হল

  • ভূমি সংস্কারের সম্প্রসারণ।
  • পাট্টা ও তহবিল প্রদান।
  • ঋণ প্রদান।
  • গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ।
  • গ্রামীণ রাস্তা ও বাজারিকরণ।
  • কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার সম্প্রসারণ ইত্যাদি।

প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী নরম্যান বােরলগ (Norman Borlaug) ও তার সহযােগীদের প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত এক বিশেষ জাতের সংকর বীজ গম উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্যলাভ করে। লারমা রােজো -644 (Lerma Rojo-644), সােনারা-64 (Sonara-64), কল্যাণ সােনা (Kalyan Sona) প্রভৃতি উচ্চফলনশীল গমের বীজ এবং আই আর-৪ (IR-8), জয়া (Jaya), পদ্মা (Padma) প্রভৃতি ধানের বীজ কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

সবুজ বিপ্লবের উপকরণ

কৃষিক্ষেত্রে যেসব নতুন কৌশল প্রয়োগ করে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় সেই সব উপকরণকে সবুজ বিপ্লবের স্তম্ভ বা উপকরণ বলা হয় । মোট 12 টি উপকরণ নির্দিষ্ট করা হয় , যার মধ্যে মুখ্য বা প্রধান উপকরণ 4 টি ।

1. উচ্চফলনশীল বীজ : সবুজ বিপ্লবে সহায়তাকারী সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল শস্য চাষে উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার । পুরানো বা সাবেকি বীজের তুলনায় এই সব বীজের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি । গম , ধান , জোয়ার , বাজরা এবং ভুট্টা — মূলত এই পাঁচ ধরনের শস্যের মধ্যেই উচ্চফলনশীল বীজ ( HYV ) সীমাবদ্ধ । 1966-67 খ্রিস্টাব্দে উচ্চফলনশীল বীজের আওতায় যেখানে 40 লক্ষ হেক্টর জমি ছিল , সেখানে 2008-09 খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় 4 কোটি 5 লক্ষ হেক্টর ।

2. সেচব‍্যবস্থা : উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহারের জন্য প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয় । তাই জলসেচ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটানো হয় । ভূপৃষ্ঠস্থ জলের পাশাপাশি ভৌমজলেরও ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার শুরু হয় । তবে এই ভৌমজল পর্যাপ্ত ব্যবহারের ফলে ভৌমজলের অবক্ষয় ঘটছে বা জলতল আরও নীচে নেমে যাচ্ছে । পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বহু জেলাই এই সমস্যার সম্মুখীন।

3. রাসায়নিক সার : উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহারের জন্য দরকার পর্যাপ্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োগ । জমির পুষ্টিসাধক বস্তুগুলির পরিমাণ বাড়লে তবেই উৎপাদন বাড়ে । 1974-75 খ্রিস্টাব্দে ভারতে যেখানে হেক্টর প্রতি রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছিল মাত্র 17 কেজি , 2012-13 খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় 128.34 কেজিতে।

4. কীটনাশক ওষুধ : উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহারের ফলে শস্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে । ভারতে প্রতিবছর প্রায় 10,000 কোটি টাকার শস্য বিভিন্ন প্রকার রোগে এবং কীটপতঙ্গের উপদ্রবে বিনষ্ট হয় । তাই সবুজ বিপ্লবের অধীনে পর্যাপ্তমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়।

5. সক্রিয় এলাকা উন্নয়ন : 1975 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে সক্রিয় এলাকা উন্নয়ন ( Command Area Development বা CAD ) প্রকল্পের অধীনে মৃত্তিকা জরিপ , ভূমির আকৃতি নির্ণয় , জমির মধ্যে খাল খনন , জলের সঠিক নিষ্কাশন ইত্যাদির উন্নয়ন ঘটানো হয় । এছাড়াও সঠিক শস্য বিন্যাস , জলনিকাশি ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ এবং জলসেচের আধুনিকীকরণও এই প্রকল্পের অন্তর্গত ছিল।

6. পাট্টা তহবিল : ভারতে কৃষির উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন ভূমিকে কৃষকের মধ্যে বিলি করে পাট্টা তহবিল গঠন করা হয় । এর ফলে কৃষকদের মধ্যে শস্য উৎপাদনে বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয় ।

সবুজ বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য

  • উচ্চ-ফলনশীল শস্যের জাত: সবুজ বিপ্লব নতুন ফসলের জাত প্রবর্তন করেছিল যেগুলি বিশেষভাবে তাদের উচ্চ-ফলন সম্ভাবনার জন্য প্রজনন করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, আধা-বামন গম এবং ধানের জাতগুলির বিকাশ শস্য উৎপাদনকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।
  • প্রযুক্তিগত উপকরণ: কৃষকরা আধুনিক কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে মাটির উর্বরতা উন্নত করতে কৃত্রিম সার ব্যবহার, কীটপতঙ্গ ও রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশক এবং রোপণ ও ফসল কাটার জন্য যান্ত্রিক কৃষি সরঞ্জাম।
  • সেচ: সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ কৃষিকে বৃষ্টিপাতের উপর কম নির্ভরশীল করতে সাহায্য করেছে, কিছু অঞ্চলে একাধিক ফসলের ঋতুর অনুমতি দিয়েছে।
  • শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ: সম্প্রসারণ পরিষেবা এবং কৃষি শিক্ষা কার্যক্রমগুলি কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি এবং অনুশীলন সম্পর্কে শেখানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের এই পদ্ধতিগুলি কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে সহায়তা করে।

সবুজ বিপ্লবের কারণ

  • জনসংখ্যা বৃদ্ধি: বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল, যার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সবুজ বিপ্লবকে ক্রমবর্ধমান বিশ্বজনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আরও খাদ্য উত্পাদন করার উপায় হিসাবে দেখা হয়েছিল।
  • প্রযুক্তিগত অগ্রগতি: উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উন্নয়ন, উন্নত সেচ কৌশল এবং কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ব্যবহার সহ কৃষি প্রযুক্তিতে অগ্রগতি সবুজ বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করেছে।
  • গবেষণা এবং বিনিয়োগ: সরকারী সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং জনহিতকর ফাউন্ডেশনগুলি কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এই তহবিল নতুন শস্যের জাতগুলির প্রজনন এবং আধুনিক কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানের প্রচারে সহায়তা করে।
  • রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ: অনেক দেশে, সরকার দারিদ্র্য হ্রাস, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রচার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের উপায় হিসাবে কৃষি উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

সবুজ বিপ্লবের ফলাফল

সবুজ বিপ্লবের ফলাফল গুলিকে মূলত দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে সুফল এবং কুফল।

সবুজ বিপ্লবের সুফল

সবুজ বিপ্লবের ফলে ভারতের কৃষিক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয় । উল্লেখযোগ্য সুফলগুলি হল-

1. মোট উৎপাদন বৃদ্ধি : সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষিজাত শস্যের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে । তৃতীয় পরিকল্পনাকালে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন যেখানে 8.2 কোটি টন ছিল সেখানে 2011-12 সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় 25.74 কোটি টন । প্রকৃতপক্ষে সবুজ বিপ্লবের ফলেই 1971 খ্রিস্টাব্দে PL – 480 পরিকল্পনা অনুযায়ী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছি।

2. হেক্টর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি : উচ্চফলনশীল বীজ , জলসেচের সুবিধা এবং কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাধ্যমে হেক্টর প্রতি উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় । 1970-71 সালে খাদ্যশস্যের গড় উৎপাদন ক্ষমতা হেক্টর প্রতি ছিল 872 কেজি । এই উৎপাদন 2009-10 সালে বেড়ে দাঁড়ায় 1,798 কেজিতে।

3. খাদ্য সমস্যার সমাধান : স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে ভারতে জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দেয় । কিন্তু সবুজ বিপ্লবের ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সমস্যার সমাধান হয়েছে।

4. কৃষকের সমৃদ্ধি : জমি থেকে উৎপাদন বাড়ায় কৃষকের আয়ও বাড়তে থাকে । তাই তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটে।

5. কৃষকের মানসিকতার পরিবর্তন : কৃষিক্ষেত্রে কৃষক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় তাদের চিরাচরিত ধারণার পরিবর্তন ঘটে । মানসিকতার পরিবর্তনের ফলে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রবর্তন করতে তাদের অসুবিধা হয় না।

6. শিল্পের বিকাশ : সবুজ বিপ্লবের ফলে কার্পাসবয়ন , শর্করা , বনস্পতি প্রভৃতি শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে।

7. গ্রামীণ কর্মসংস্থান : জমিতে সার প্রয়োগ এবং বহু – ফসলি চাষের ফলে গ্রামীণ লোকের কাজের সুযোগ বেড়েছে। গোবিন্দ থুকরাল ( Gobind Thukral ) – এর মতে পাঞ্জাবে প্রায় এক লক্ষ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় । 15 লক্ষের মতো গরিব মানুষ বিহার , পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং ওডিশাতে কাজ পায় । তবে এই কর্মসংস্থান বিষয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।

সবুজ বিপ্লবের কুফল

সবুজ বিপ্লবের সুফলের পাশাপাশি কিছু ক্ষতিকর প্রভাবও রয়েছে সেগুলি হল –

1. আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি : সবুজ বিপ্লব ভারতের সর্বত্র সমানভাবে সাফল্য লাভ করেনি । পাঞ্জাব , হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে সবুজ বিপ্লব যতখানি ফলপ্রসূ হয়েছে , অন্যত্র তা হয়নি । এই অসম প্রসারের ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছ । তবে সাম্প্রতিক কালে এই অসমতা কিছুটা দূরীভূত হয়েছে সবুজ বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ের সুফল হিসেবে।

2. শ্রেণিগত বৈষম্য বৃদ্ধি : অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ধনী চাষি সবুজ বিপ্লবের সুযোগ বেশি মাত্রায় গ্রহণ করে আরও বেশি সচ্ছল হয়েছে । অন্যদিকে , ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি দিনে দিনে বেশি নিঃস্ব হয়েছে।

3. ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থা : কৃষিজ উৎপাদনের নতুন কৌশল পুঁজিবাদী খামার ( Capitalist farms ) গড়ে তুলেছে । একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় , পাঞ্জাবে মাত্র এক – তৃতীয়াংশ প্রান্তিক চাষি এবং 24.5 % ক্ষুদ্র চাষি দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে।

4. অনিশ্চিত কর্মসংস্থান : অনেকের মতে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে।

5. দারিদ্র্যের প্রকোপ : কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে আঞ্চলিক বৈষম্য এবং গ্রামাঞ্চলে মানুষের আয়গত বৈষম্য ঘটায় দারিদ্র্যের প্রকোপ বেড়েছে । অবশ্য অনেকের মতে , উৎপাদন বাড়ায় খাদ্যশস্যের দাম কমেছে।

6. অসম গুরুত্ব প্রদান : খাদ্যশস্য উৎপাদনে কেবলমাত্র গমের ওপরই বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হয় । অন্যান্য শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎসাহের অভাব স্পষ্ট । তাই অনেকেই সবুজ বিপ্লবকে ‘ গম বিপ্লব ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

7. কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের অসুবিধা : ব্যাপকমাত্রায় যান্ত্রিকীকরণের ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনাজনিত সমস্যার সৃষ্টি হয় । সামাজিক নিরাপত্তাজনিত সুযোগসুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনও সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠেনি।

8. রাসায়নিক সারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার : রাসায়নিক সারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকা ও জল দূষিত এবং তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে । অনেকক্ষেত্রে আবার উৎপাদনশীলতা কমেছে।

9. পরিবেশের ওপর কুপ্রভাব : সবুজ বিপ্লবের ফলে পরিবেশের গুণগত মানের অবনমন ঘটছে । মৃত্তিকায় লবণতা বৃদ্ধি , নদী , হ্রদ এবং বিভিন্ন জলভাগে দূষণের মাত্রা বাড়ায় তার প্রভাব উপকূল অঞ্চলের সমুদ্রে স্পষ্ট হয়েছে । তাই সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে। উপরের অসুবিধা গুলির জন‍্য অনেকেই সবুজ বিপ্লবকে ‘ধূসর বিপ্লব‘ হিসেবে আখ‍্যা দিয়েছেন।

সবুজ বিপ্লবের প্রভাব

সবুজ বিপ্লব প্রথম কোথায় হয়েছিল

সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় ১৯৪৪ সালে, মেক্সিকোয়। মূলত উচ্চ ফলনশীল গম জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এ বিপ্লবের যাত্রা শুরু হয়। এর নেতৃত্ব দেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কৃষি বিজ্ঞানী ড. নরমোন-ই বোরলগ। ১৯৪৩ সালে মেক্সিকো যেখানে তার প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেক শস্য বিদেশ থেকে আমদানি করত, সেখানে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৫১ সালের মধ্যেই ওই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এবং ১৯৬৪ সালে মেক্সিকো প্রায় অর্ধ মিলিয়ন টন গম বিদেশে রফতানি করতে সক্ষম হয়।

ভারতে সবুজ বিপ্লবের সময়কাল

ভারতে ‘ সবুজ বিপ্লব ’ – এর বীজ প্রথম ব্যবহৃত হয় 1964-65 খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত খরার বছরে । 1963 খ্রিস্টাব্দে ড . বোরলগের সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞানীদের পরিচয় এবং সাক্ষাৎ হয় । এই সময়ে ভারতে বিদেশ থেকে 100 কেজি উচ্চফলনশীল গম বীজ আমদানি করে লুধিয়ানা , পুসা এবং কানপুরের মৃত্তিকায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হয় এবং দেখা যায় স্থানীয় বীজের উৎপাদন অপেক্ষা চারগুণ বেশি উৎপাদন হয় ।

1966 খ্রিস্টাব্দে প্রায় 16,000 টন গম বীজ আমদানি করে প্রায় 4 লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় । 1967-68 সালের উৎপাদন 1966-67 – এর উৎপাদন অপেক্ষা প্রায় 25 % বৃদ্ধি পায় । শস্য উৎপাদনের এই অভাবনীয় অগ্রগতির মাধ্যমেই ভারতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় ।

সবুজ বিপ্লবের জনক কে, বিশ্বের সবুজ বিপ্লবের জনক কে

ডক্টর নরম্যান আর্নেস্ট বোরলগ কে সবুজ বিপ্লবের জনক বলা হয়। তিনি 1970 খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

মেক্সিকোর ‘ গম উন্নয়ন কর্মসূচির ’ ( Wheat Development Programme ) কর্ণধার ড . নরম্যান আর্নেস্ট বোৱলগ ( Dr. Norman Earnest Borlaug ) – এর উদ্যোগে 1951 খ্রিস্টাব্দে নতুন গম বীজ উদ্ভাবনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় । এর ফলে মেক্সিকোতে 1961 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গমের হেক্টর প্রতি উৎপাদন 7,000 কেজি দাঁড়ায় যা পূর্বে ব্যবহৃত বীজে হেক্টর প্রতি উৎপাদনের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি ।

ধানের ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় ম্যানিলাতে ‘ আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সংস্থা ’ ( International Rice Research Institute বা IRRI ) স্থাপনের মাধ্যমে । এখানে উন্নতমানের উচ্চফলনশীল ধানের বীজ উদ্ভাবন করা হয় । ধান গবেষণার কিছু কাজ অবশ্য তাইওয়ানেও হয়।

ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক কে, ভারতে সবুজ বিপ্লবের জনক কে

ডক্টর এম এস স্বামীনাথন কে ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক বলা হয়। তিনি আলু, গম ও ধানের জিন তত্ত্বের উপর গবেষণা করেন। মেক্সিকোয় বামন প্রজাতির গমের উপর তিনি সফল সংকরায়ন ঘটান।

যেহেতু ভারতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা M. S. Swaminathan হাত ধরে হয় তাই ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক বলা হয়। 1960 এর দশকে যখন ভারতে খাদ্য শস্যের অভাব দেখা দেয় তখন ভারতের এই কৃষি বিশেষজ্ঞ M. S. Swaminathan এবং বিদেশ থেকে আসা Norman Borlaug এর সহযোগিতায় ভারেতে সবুজ বিপ্লব হয়।

স্বাধীনােত্তর ভারতে 1960-এর দশকে কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ফসল উৎপাদনে যে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে, তাকে সবুজ বিপ্লব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। শস্যের রং সবুজ বলে সবুজ বিপ্লব শব্দটি জনপ্রিয় হয়।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (1956-1961) ফোর্ড ফাউন্ডেশন-এর একদল বিজ্ঞানী ‘India’s Food Crisis and Steps to Meet It’ নামে যে রিপোের্ট জমা দেন তার ভিত্তিতে 1960 খ্রিস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গােদাবরী, বিহারের শাহাবাদ, ছত্তিশগড়ের রায়পুর, তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভূর, পাঞ্জাবের লুধিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের আলিগড় এবং রাজস্থানের পালি জেলায় নিবিড় কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচি (Intensive Agricultural Development Programme or IADP)-র কাজ শুরু হয়। এই কর্মসূচিটিই পরে উচ্চফলনশীল বীজ কর্মসূচি (High-yielding Varieties Programme or HYVP) নামে পরিচিত হয়। কৃষির দ্রুত ও বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনমুখী এই কর্মসূচি পরবর্তীকালে সবুজ বিপ্লব বা Green Revolution নাম ধারণ করে।

আরো অন্যান্য সরকারি স্কিম সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন 

FAQ | সবুজ বিপ্লব

Q1. সবুজ বিপ্লব কি

Ans – ভারতের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (1961-66 ) তথা ষাটের দশকে ভারতীয় কৃষিকার্যে উন্নত আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে, অল্প সময়ে কৃষিজ উৎপাদনে যে অভূতপূর্ব ও বৈপ্লবিক বৃদ্ধি ঘটে, তাকে সবুজ বিপ্লব বলে।

Q2. “সবুজ বিপ্লব”” হয়েছিল কোন কৃষি উৎপাদনে”

Ans – খাদ্যশস্য মূলত ধান ও গম।

Q3. সবুজ বিপ্লব কথাটি প্রথম কে ব্যবহার করেন

Ans – সবুজ বিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন – উইলিয়াম এস. গ্যাড।

Q4. কোন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সবুজ বিপ্লব হয়, সবুজ বিপ্লব কোন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় হয়

Ans – চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সবুজ বিপ্লব হয়।

Q6. সবুজ বিপ্লব শব্দটি কে চালু করেন

Ans – সবুজ বিপ্লব শব্দটি সর্বপ্রথম ইউ. এস. এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (USAID) এর প্রশাসক উইলিয়াম এস গাউড ব্যবহার করেছিলেন।

Q7. সবুজ বিপ্লব প্রথম কোথায় হয়েছিল ?

Ans – ভারতে প্রথম সবুজ বিপ্লবের বীজ ব্যবহার করা হয় 1964-65 সালে বিশেষত পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশে ( UP ) তে ।

আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারিবেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন

আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্ট শেয়ার করতে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।