- সাঁওতাল বিদ্রোহ কাকে বলে
- সাঁওতাল বিদ্রোহ
- সাঁওতাল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য
- সাঁওতাল বিদ্রোহ কবে হয়েছিল
- সাঁওতাল বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল
- সাঁওতাল বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম, সাঁওতাল বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম
- সাঁওতাল বিদ্রোহ কারণ ও ফলাফল, সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল
- সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ, সাঁওতাল বিদ্রোহ কেন হয়েছিল
- সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল
- সাঁওতাল বিদ্রোহ ছবি
- সাঁওতাল বিদ্রোহের এলাকা
- সাঁওতাল বিদ্রোহের এলাকা মানচিত্র
- সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি
- সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব
- সাঁওতাল বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ
- সাঁওতালি ভাষার লিপির নাম কি, সাঁওতালি ভাষার লিপির নাম
- FAQ | সাঁওতাল বিদ্রোহ
সাঁওতাল বিদ্রোহ কাকে বলে
১৭৯৩ সালে দেশে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে উপজাতিদের উপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে যাঁরা বিদ্রোহের পথ নিয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান উপজাতি হল সাঁওতালরা। এরা ছিল পরিশ্রমী, সরলমতি এক কৃষিজীবী উপজাতি বা আদিবাসী শ্রেণী। ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়।
ড: বিপিন চন্দ্র, বরুণ দে ও অমলেশ ত্রিপাঠী “ফ্রীডম স্ট্রাগল (Freedom Struggle)” গ্রন্থে বলেছেন অরণ্য বৃক্ষের অধিকারকে কেন্দ্র করে সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়। তাদের দামিন-ই-কোহ অঞ্চলে এই বিদ্রোহ হয়েছিল। সাঁওতালরা ভাগলপুর ও রাজমহলের মধ্যভাগে দামিন-ই-কোহ নামক অঞ্চলে বাস করত। পরে সাঁওতালরা প্রধানত বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, মালভূম প্রভুতি অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত।
১৮৫১ সালে এই “দামিন-ই-কোহ” অঞ্চলে প্রায় ১,৪৩৭ টি সাঁওতাল গ্রাম ছিল এবং প্রায় ৮২,৭১৫ জন সাঁওতাল আদিবাসী এখানে বাস করত। ১৮৫৫ সালে সাঁওতালরা ডিকু বা বহিরাগতদের বিতাড়িত করতে সংকল্প নেন। জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৫৫ সালে বিহারের ছোটনাগপুরের ভাগনাডিহি গ্রামে সিধু ও কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহ
সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করত, যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম জঙ্গল কেটে জমি চাষের উপযোগী করে, জমির মালিকানা তারই। মুগল সরকার এই ঐতিহ্যকে সম্মান করায় তখন কোন সমস্যা হয় নি। কিন্তু ইংরেজ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জমিদাররা জমির উপর তাদের মালিকানার দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। এই স্বাভাবিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ১৮১১, ১৮২০ ও ১৮৩১ সালে সাঁওতালদের মধ্যে বৃটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ, সুসংগঠিত ও ব্যাপক বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় ১৮৫৫-৫৬ সালে এবং তা দমন করতে সরকারকে কয়েক দফা সামরিক অভিযান প্রেরণ করতে হয়।
সাঁওতালরা বাঙালিদের ‘মইরা’ ও ‘দিকু’ নামে ডাকত এবং তাদের শত্রু মনে করত, কেননা এই বাঙালিরাই ছিল জমিদার, মহাজন, দোকানদার ও রেলওয়ে শ্রমিক-ঠিকাদার, যারা কমবেশি সবাই ছিল শোষক ও নির্যাতনকারী। এইসব মইরা ও দিকুর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সাঁওতালরা ১৮৫৫ সালের গোড়ার দিকে সংগঠিত হতে শুরু করে। যখন সাঁওতাল নেতা বীর সিংহকে পাকুড় রাজের কাচারিতে তলব করে তার অনুসারীদের সামনে নিষ্ঠুরভাবে মারধর করে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়, তখনই শুরু হয় মূল বিদ্রোহ।
একতা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে গৃহীত শাল বৃক্ষ স্পর্শ করে সাঁওতালরা শপথ গ্রহণ করে। ১৮৫৫ সালের জুন মাস থেকে বিদ্রোহ দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ গণঅভ্যুত্থানের মতো সাঁওতালরাও গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে। ডাক ও রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তাদের এলাকা থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং রেলওয়ে শ্রমিক নিয়োগকারী ঠিকাদার, যারা সাঁওতাল মেয়েদের ফুসলিয়ে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করত, তাদেরকে পাওয়ামাত্র হত্যা করা হয়। জমিদারকে খাজনা প্রদান পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মহাজনের তমসুক বা বন্ধকীপত্র এক ঘোষণার দ্বারা বাতিল করা হয়।
পিপলিতে সাঁওতালরা মেজর বারোজের নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক অভিযানকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করে। এই বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে সাঁওতালরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ১৮৫৫ সালের ১৯ জুলাই সামরিক আইন জারি করা হয়। সাঁওতালদের দমনের জন্য তিনটি সৈন্যদল পাঠানো হয়। সাঁওতালদের রক্তে সিক্ত হয় রাজমহল পার্বত্য এলাকা। তাদের সবকটি গ্রাম ধ্বংস করা হয়। বন্দি সাঁওতালদের শিকলবদ্ধ অবস্থায় রেলপথ নির্মাণের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে নেতৃস্থানীয় সাঁওতালদের অধিকাংশই ধরা পড়ে এবং লোক দেখানো বিচার করে তাদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। অবশেষে ১৮৫৬ সালের মার্চে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে অনুরূপ কোন বিদ্রোহ যাতে না হয়, সেজন্য জমির মালিকানা স্বত্ত্ব দিয়ে রাজমহল পাহাড়ে বিপুল সংখ্যক মইরা ও দিকুদের বসতির ব্যবস্থা করা হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য
সাঁওতাল সম্প্রদায় 1855 সালে অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার ও তাদের অনুযোগী জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। সাঁওতাল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যগুলি গুলি হল-
1. সকলেই অংশগ্রহণ : সাঁওতাল বিদ্রোহে নারী – পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের এবং সব বয়সের সাঁওতালরা অংশগ্রহণ করে। ফলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
2. গণবিদ্রোহ : সাঁওতালরা ছাড়াও স্থানীয় নিম্নবর্ণের বিভিন্ন মানুষ যেমন- কামার , কুমোর ,গোয়ালা , ডোম, তাঁতি প্রভৃতি বর্ণ ও পেশার মানুষও সাঁওতাল বিদ্রোহে অংশগ্ৰহণ করে। ফলে সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রকৃত গণবিদ্রোহে পরিণত হয়।
3. ব্রিটিশ বিরোধিতা : সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে থেকে ব্রিটিশ শক্তির আধিপত্য লুপ্ত করাইছিল বিদ্রোহীদের মূল উদ্দেশ্য।
4. অস্ত্রের লড়াই : সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল সাঁওতাল ও ইংরেজ বাহিনীর মধ্যে অসম অস্ত্রশস্ত্রের লড়াই। আদিবাসী সাঁওতালরা সেকেলে তিরধনুক, বল্লম নিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দেয়।
5. ব্রিটিশ অনুযোগীদের বিরোধিতা : শুধু ব্রিটিশ শাসন নয় ব্রিটিশদের সহযোগী বাইরে থেকে আগত জমিদার ও মহাজনদের বিরোধিতা এবং তাদের ধ্বংসসাধনও বিদ্রোহীদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
6. এতে যুবকদের পাশাপাশি কিশোর, বৃদ্ধ, নারীরাও সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছিলসন্তান কোলে নিয়ে নারীরা কারাবরণ করত।
সাঁওতাল বিদ্রোহ কবে হয়েছিল
সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁতাল হুল হলো ১৯ শতকে ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত একটি ঔপনিবেশিক ও জমিদারি শাসন-বিরোধী আন্দোলন, যাকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী নেতৃত্ব দিয়েছিলো। এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়।
সাঁওতাল বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল
1855 খ্রিষ্টাব্দের 30 শে জুন সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হলেও অচিরেই এই বিদ্রোহ ভাগলপুর, মুঙ্গের, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সমর্থনে কামার, কুমোর, ছুতোর ও তাঁতিরাও এগিয়ে আসে এবং তাদের হাতে বহু জমিদার ও মহাজন নিহত হন। সিধু-কানহু ছাড়াও চাঁদ, ভৈরব, বীর সিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখ এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। অবশেষে 1856 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশাল সেনাবাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহ দমন করে। সিধু, কানহুসহ অন্যান্য সাঁওতাল নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয় এবং বহু সাঁওতাল বিদ্রোহীর 7 থেকে 14 বছর কারাদণ্ড হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সৈন্যরা প্রায় 36 টি সাঁওতাল গ্রাম ধ্বংস করে দেয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম, সাঁওতাল বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম
সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, ডোমন মাঝি ও কালো প্রামাণিক। কলিয়ান হরাম ছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসের লিপিকার ও সাঁওতালদের গুরু। তিনি তাঁর “হরকোরেন মারে হাপরাম্বো রিয়াক কথা” শীর্ষক একটি রচনায় সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত লিখে রেখে গেছেন। এই ইতিবৃত্তে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু ও কানুর সংগ্রাম-ধ্বনি, যথাঃ “রাজা-মহারাজাদের খতম করো”, “দিকুদের (বহিরাগত মহাজনদের) গঙ্গা পার করে দাও”, “আমাদের নিজেদের হাতে শাসন চাই” প্রভৃতি লেখা আছে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ কারণ ও ফলাফল, সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালে ভারতে যে সমস্ত কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ হয়েছিল সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 1855-56 সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ। কঠোর পরিশ্রমী শান্তিপ্রিয় ও সরল প্রকৃতির কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাঁওতালরা ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশদের আশ্রয়পুষ্ট জমিদার ও মহাজনদের নির্মম শোষনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল তখ সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের পিছনে ছিল একাধিক কারণে সমাবেশ। সেগুলি হল-
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ, সাঁওতাল বিদ্রোহ কেন হয়েছিল
1. রাজস্ব আরোপ : আদিবাসী সাঁওতালরা অরণ্য অঞ্চলের পতিত জমি উদ্ধার করে চাষবাসের জন্য উর্বর করে তোলে। ব্রিটিশ শাসনকালে সরকার নিযুক্ত জমিদাররা সেই জমির ওপর উচ্চমাত্রায় রাজস্বের বোঝা চাপানোর কারণে সাঁওতাল কৃষকরা জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
2. অন্যান্য কর : ভূমিরাজস্ব ছাড়াও সরকার, জমিদার প্রমুখ সাঁওতালদের ওপর বিভিন্ন ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। যার কারণে দরিদ্র সাঁওতালদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পরে।
3. ব্যবসায়ী শ্রেণীর প্রতারণা : বাইরে থেকে আগত ব্যবসায়ীরা কেনারাম নামক বাটখারা ব্যবহার করে সাঁওতালদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনার সময় এবং বেচারাম নামক বাটখারা ব্যবহার করে নিজেদের পণ্যগুলি সাঁওতালদের কাছে বিক্রির সময় তাদের সাথে প্রতারণা করতো।
4. মহাজনদের অত্যচার : সাঁওতালরা নগদে ভূমিরাজস্ব ও অন্যান্য কর পরিশোধ করতে গিয়ে মহাজনদের কাছ থেকে অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হত। পরবর্তীকালে ঋণের দায়ে তার জমি , ফসল , বলদ কেড়ে নেওয়া হত।
5. সাঁওতাল আইন বাতিল : সরকার সাঁওতালদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা বাতিল করে সাঁওতাল এলাকায় ইংরেজদের জটিল আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রচলন করে।
6. রেলপথ নির্মাণ : সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের কাজে সাঁওতাল শ্রমিকদের নিয়োগ করে তাদের খুব কম মজুরি দেওয়া হত। তা ছাড়া রেলের ঠিকাদার ও ইংরেজ কর্মচারীরা সাঁওতাল পরিবারগুলির ওপর নানাভাবে অত্যাচার করত।
7. নীলচাষ : নীলকর সাহেবরা সাঁওতাল কৃষকদের উপর অত্যাচার করে তাদের নীলচাষে বাধ্য করত।
8. কর্মচারী ও ঠিকাদারের শোষণঃ- 1853 সালে লর্ড ডালহৌসি রেলপথের কাজ শুরু করলে কিছু ইংরেজ কর্মচারী ও ঠিকাদারদের স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ করত। তাঁদের হাঁস,মুরুগি,ছাগল কেড়ে নিত,এমনকি সাঁওতাল মেয়েদের সম্মানে হাত দিতেও তারা কুন্ঠাবোধ করেনি।
9. ধর্মীয় উন্মাদনা এবং সিধু-কানহুর নেতৃত্বদান:-সাঁওতাল বিদ্রোহের পিছনে ধর্মীয় উন্মাদনাও কাজ করেছিল। খ্রিষ্টান মিশনারীরা জোর করে সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করলে সাঁওতালরা ক্ষুব্দ হয়। এমতাবস্থায় 1850 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাঁওতাল নেতা সিধু ও কানহু ঘোষণা করেন যে, “ঈশ্বর তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই বিদ্রোহে তাদের জয় হবে। কারণ ঈশ্বর স্বয়ং তাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন।”তারা প্রচার করেন, “ঈশ্বরের দয়ায় ইংরেজদের বুলেট নিষ্ফল হবে, যারা যুদ্ধে নিহত হবে তারা ঠাকুরের দোয়ায় আবার জীবিত হয়ে উঠবে।”এইসব বক্তব্য প্রচার নিরক্ষর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাঁওতালদের মনে আশার সঞ্চার করে। অবশেষে 1855 খ্রিষ্টাব্দের 30 শে জুন সিধু ও কানহুর নেতৃত্বে প্রায় 10 হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে সমবেত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল পরগনা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল
সাঁওতাল উপজাতিরা ব্রিটিশ সরকার , তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ করেও শেষপর্যন্ত পরাজিত হয়। সাঁওতালরা এই বিদ্রোহে ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের ফলাফলগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই বিদ্রোহের ফলাফল গুলি হল-
1. সোচ্চার প্রতিবাদ : এই বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে সাঁওতালরা ইংরেজ আশ্রয়ধীন জমিদার ও মহাজনশ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুর করে। তাদের সোচ্চার প্রতিবাদ ব্রিটিশ – বিরোধী আন্দোলনকে প্রেরণা দিয়েছিল।
2. অপর শ্রেণীর মানুষের যোগদান : সাঁওতাল বিদ্রোহ কেবল সাঁওতাল জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই বিদ্রোহে বিভিন্ন নিম্নবর্ণের মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে।
4. প্রেরণা : সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতাল চাষিদের বিদ্রোহের আগুন নিভে ছিল না । পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গরিব ও নিম্নবর্ণের সাঁওতালদের এই বিদ্রোহ প্রেরণা জুগিয়েছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মন্তব্য অনুযায়ী , “ সাঁওতাল বিদ্রোহ আপসহীন গণসংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । ”
5. সরকারি নমনীয়তা : বিদ্রোহের পর সরকার সাঁওতালদের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে।
6. বীরত্ব : সাঁওতাল বিদ্রোহে দরিদ্র কৃষকদের স্বাধীনতা লাভ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা লক্ষ করা যায়। সাঁওতালরা সশস্ত্র ইংরেজ বাহিনীর সামনে তিরধনুক, বর্শা, কুড়ুল প্রভৃতি নিয়ে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তা পরবর্তীকালে আন্দোলনকে সাহস জুগিয়েছিল।
7. খ্রিস্টধর্মের প্রসার : সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে তাঁদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্যবোধ জাগরিত করেন।
7. স্বাধীনতা সংগ্রাম : ড . রমেশচন্দ্র মজুমদারের মন্তব্য অনুসারে, যদি 1857 এর মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয় , তবে সাঁওতালদের এই অকন্ঠক আপামর সংগ্রামকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ছবি
সাঁওতাল বিদ্রোহের এলাকা
চুনায় মুর্মুর দুই পুত্র সিধু ও কানুর নির্দেশে ১৮৫৫ সালে ৭ জুলাই বিহারের ভাগনাডিহি গ্রামে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল, কালক্রমে বীরভূম, ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ, রাঁচি, হাজারীবাগ, ছোটনাগপুর, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পালামৌ প্রভুতি অঞ্চলে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এরা ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল।
নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সাঁওতালদের প্রতি সমর্থন জানায়। দীঘি খানার দারোগা মহেশ দত্তকে হত্যা করে। সাঁওতালদের দমনের জন্য ভাগলপুর থেকে মেজর বারোজ আসলে সাঁওতালরা তাকে পীরপাইতির যুদ্ধে পরাস্ত করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহিরা মহাজন নিধন যজ্ঞে মেতে ওঠে। লর্ড ডালহৌসি এই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে। বারহাইতের যুদ্ধে সাঁওতালরা শোচনী়ভাবে পরাজিত হয়। চাঁদ ও ভৈরব নিহত হন। সিধু ও কানু ধরা পড়েন।
সাঁওতাল বিদ্রোহের এলাকা মানচিত্র
আরো পড়তে: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি
1. আদিবাসী বিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী বা উপজাতি সাঁওতালদের বিদ্রোহ। আদিবাসী সাঁওতালরাই ছিল এই বিদ্রোহের মূল প্রাণকেন্দ্র।
2. কৃষকবিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি কৃষকবিদ্রোহ। দরিদ্র ও শোষিত আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকরা, জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।
3. ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু জমিদার বা মহাজন – বিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। এই বিদ্রোহ ছিল স্পষ্টতই ব্রিটিশ – বিরোধী। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে মন্তব্য করেন, ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোই এই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য ছিল।
4. গণবিদ্রোহ : সাঁওতাল কৃষকদের উদ্যোগে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও স্থানীয় কামার , কুমোর, গোয়ালা , মুসলিম তাঁতি ,তেলী, চামার, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায় ও পেশার মানুষও এই বিদ্রোহে যোগ দেয়। তাই নরহরি কবিরাজ একে সকল সম্প্রদায়ের দরিদ্র জনগণের মুক্তিযুদ্ধ বলে মতপ্রকাশ করেছেন।
5. ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ : কেউ কেউ সাঁওতাল বিদ্রোহে ধর্মের প্রভাব দেখতে পেলেও এই বিদ্রোহ প্রধানত ধর্মকেন্দ্রিক ছিল না। বিদ্রোহী সাঁওতালরা ঈশ্বরকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি।
নানা বিতর্ক থাকলেও এ কথা সত্য যে, বহুমুখী অন্যায় – অত্যাচার , শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাঁওতাল উপজাতির এই বিদ্রোহ এক আপসহীন সংগ্রামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গড়ে তুলেছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব
সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই বিদ্রোহের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের সম্পর্কে কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে।
- সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করা হয় এবং সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- সাঁওতাল পরগনায় সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয় এবং মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ইউরোপীয় মিশনারী ছাড়া অন্যান্য মিশনারীদের সাঁওতাল পরগনায় প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়।
- সাঁওতালদের অভাব-অভিযোগের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করা হয়নি বা সাঁওতালদের জমির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াও হয়নি।
- সাঁওতাল বিদ্রোহের পর সাঁওতাল পরগনায় ইউরোপীয় মিশনারী ছাড়া অন্যান্য মিশনারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলে ইউরোপিয় খ্রিস্টান মিশনারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে তাদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য বোধ সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠেন।
- সাঁওতাল বিদ্রোহ কৃষক কথা সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগায়, যা পরবর্তীকালে 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে, “এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিলো এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরূপ।
- অনেক ঐতিহাসিকের মতে, 1855 খ্রিষ্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে, “এই বিদ্রোহ ছিল সকল সম্প্রদায়ের জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ।”কারণ সাঁওতাল যুবকরা এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি হলেও কামার, কুমোর, ছুতোর ও তাঁতি সম্প্রদায় কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, এমনকি নারীরাও এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, যদি 1857 খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহ কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতালদের এই সুকঠিন সংগ্রামকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত। সবশেষে ঐতিহাসিক কালীকিংকর দত্তের মতানুসারে বলা যায়, “This episode opened a new chapter in the history of Bengal and Bihar.”
সাঁওতাল বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ
- ইংরেজ সরকার ছিল প্রভূত আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী। তাছাড়া নীলকর এবং জমিদার শ্রেণীও ইংরেজদের এই বিদ্রোহে সাহায্য করেছিল। অন্যদিকে আর্থিক দিক থেকে দুর্বল সাঁওতালদের আর্থিকভাবে সাহায্য করার মতো লোক না থাকায় এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।
- ইংরেজ বাহিনী ছিল রনকৌশলে নিপুণ অন্যদিকে সাঁওতালরা ছিল যুদ্ধে অনভিজ্ঞ।
- ইংরেজ বাহিনীর আধুনিক হাতিয়ারের কাছে সাঁওতালরা প্রাচীন আমলের তীর- ধনুক- বল্লম প্রভুতি হাতিয়ার নিয়ে টিকে থাকতে পারিনি।
- অভিজ্ঞ সেনা নায়ক সাঁওতালদের ছিল না বা সংখ্যায় কম ছিল।
- সর্বপরি সাঁওতালদের কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না।
সাঁওতালি ভাষার লিপির নাম কি, সাঁওতালি ভাষার লিপির নাম
বেশির ভাগ সান্তালী ভাষাভাষী মানুষ ভারতের ঝাড়খণ্ড, আসাম, বিহার, ওড়িশা, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বাস করে। সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব লিপি আছে, যার নাম অলচিকি লিপি (ᱚᱞ ᱪᱤᱠᱤ)।
আরো অন্যান্য অতি জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন
FAQ | সাঁওতাল বিদ্রোহ
Q1. সাঁওতাল বিদ্রোহ কি
Ans – সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁতাল হুল হলো ১৯ শতকে ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত একটি ঔপনিবেশিক ও জমিদারি শাসন-বিরোধী আন্দোলন, যাকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী নেতৃত্ব দিয়েছিলো। এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়।
Q2. সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান নেতা কারা ছিলেন
Ans – সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান নেতা সিধু ও কানু ছিলেন।
Q3. সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক কি ছিল
Ans – সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক ছিল শাল গাছ।
Q4. সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক ছিল কোন গাছ
Ans – সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক ছিল শাল গাছ ।
Q5. সাঁওতাল বিদ্রোহ কোথায় শুরু হয়েছিল
Ans – সাঁওতাল বিদ্রোহ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর শুরু হয়েছিল।
আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন।