উপনিবেশ কি, উপনিবেশ কাকে বলে
যখন কোনো দেশ অপর একটি দেশের ব্যবসা বাণিজ্য করায়ত্ত করে অর্থাৎ তার অর্থনৈতিক খমতা দখল করে, সেই আক্রান্ত দেশকে উপনিবেশ বলে। যেমন ভারত ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল।
উপনিবেশ (Colony) একটি স্থান বা এলাকা যা অন্য কোন দেশ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রধান নগর হিসেবে দেশটি উপনিবেশের বৈধ দখলদার। একটি দেশের যখন অনেকগুলো উপনিবেশ থাকে তখন মূল দেশটি সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত হয়। বিশ্বের প্রাচীনতম উপনিবেশ পুয়ের্তো রিকো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
উপনিবেশে অবশ্যই অনেক লোকসংখ্যা থাকতে হবে। বিশ্বে একসময় অনেক উপনিবেশ ছিল যা বর্তমানে স্বাধীন দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। অধিকাংশ দেশই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ন্ত্রিত ছিল। বর্তমানে এ সকল দেশই কমনওয়েলথভূক্ত দেশের সদস্য।
উপনিবেশ বা কলোনী শব্দটি ল্যাটিন শব্দ কলোনিয়া থেকে উদ্ভূত। প্রাচীন গ্রিসে উপনিবেশের নিয়ন্ত্রককে মেট্রোপোলিশ বা প্রধান নগর বলা হতো। একটি উপনিবেশকে প্রায়শঃই নির্দিষ্ট কোন না কোন দেশ কর্তৃক শাসন করা হতো কিংবা উপনিবেশটি নিজেই স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতো। পুতুল রাজ্য বা নিয়ন্ত্রিত রাজ্যরূপে উপনিবেশের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব করার কোন স্বাধীন স্বত্ত্বা বা অধিকার নেই। এর শীর্ষ পর্যায়ের প্রশাসন ব্যবস্থা প্রধান নগর বা রাজধানী থেকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।
প্রাচীনকালের উপনিবেশ
- আলেকজান্দ্রিয়া, দুরেস, মার্সেইল গ্রিক উপনিবেশ হিসেবে গঠিত হয়।
- কার্থেজ ফোনিসিয়ান উপনিবেশ ছিল।
- সাইরেন গ্রিসের থেরার উপনিবেশ ছিল।
- কোলন রোমান উপনিবেশ ছিল। এর আধুনিক নামটি ল্যাটিন ভাষা কলোনিয়া থেকে সৃষ্ট।
আধুনিক উপনিবেশ
- ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতার পূর্ব-পর্যন্ত এঙ্গোলা কয়েক শতক ধরে পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল।
- ব্রিটিশ অনুসন্ধানকারী ও নাবিক জেমস কুক ১৭৭০ সালে অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে পদার্পণ করে একে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে দাবী করেন।
- ব্রাজিল ১৮২২ সালে স্বাধীনতার পূর্বে কয়েক শতাব্দী পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল।
- কানাডা প্রথমে ফ্রান্স ও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনাধীন উপনিবেশ ছিল।
- ১৮৪১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হংকং ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। ম্যাকাও পর্তুগীজ উপনিবেশরূপে ১৫৫৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে ছিল। উভয় উপনিবেশই পরবর্তীতে চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চেল পরিণত হয়।
- ষোড়শ শতকের শুরুতে আধুনিক ভারতের অংশবিশেষ পর্তুগালের নিয়ন্ত্রণে ছিল; যা সমষ্টিগতভাবে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পর্তুগীজ ইন্ডিয়া নামে পরিচিতি ছিল। ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে যুক্তরাজ্য সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো।
- ১৬০০ থেকে ১৯৪৫/১৯৪৯ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া ডাচ উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত জাপানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এর পূর্বে ১৫২১ সাল থেকে স্পেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল বর্তমান স্বাধীন দেশটি।
- ফিলিপাইন ১৫২১ থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত স্পেনের এবং ১৮৯৮ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত জাপানের সামরিক বাহিনী উপনিবেশটির নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছিল।
বর্তমান উপনিবেশ
- রিও ডি ওরো / পশ্চিম সাহারা মরক্কোর অনেক উপনিবেশের একটি হিসেবে পরিগণিত। পাশাপাশি আফ্রিকা মহাদেশের সর্বশেষ উপনিবেশরূপে পরিচিত এটি।
- চিলির বিশেষ অঙ্গরাজ্য হিসেবে ইস্টার আইল্যান্ডের নাগরিকেরা চিলির নাগরিকত্ব প্রাপ্তির পূর্ণ দাবীদার।
- ফ্রান্সের অনেকগুলো উপনিবেশ রয়েছে। তন্মধ্যে – ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, সেন্ট বার্থলেমাই, সেন্ট মার্টিন, সেন্ট পিয়েরে এন্ড মিকুইলন, ওয়ালিস এন্ড ফুতুনা, নিউ ক্যালিদোনিয়া অন্যতম।
- যুক্তরাজ্যের উপনিবেশগুলো হচ্ছে – ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, জিব্রাল্টার এবং ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ।
- যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশগুলো হিসেবে আমেরিকান সামোয়া, পুয়ের্তো রিকো, গুয়াম, নর্দান ম্যারিয়ানা আইল্যান্ড, ইউনাইটেড স্টেটস ভার্জিন আইল্যান্ড রয়েছে।
উপনিবেশবাদ কি, উপনিবেশবাদ কাকে বলে
উপনিবেশবাদ বলতে একটি দেশ কর্তৃক অন্য একটি দেশের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে বোঝায় , যা প্রায়ই উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। সাধারণত উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে উদ্দেশ্য থাকে অর্থনৈতিক আধিপত্য।
শব্দের উৎস এবং অর্থ: উপনিবেশবাদ শব্দটি ইংরেজি ‘Colo-nialism’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। আবার উপনিবেশবাদ বা ‘Colo-nialism’ কথাটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘Colonia’ থেকে যার অর্থ হল বিশাল সম্পত্তি বা এস্টেট (estate)।
সংজ্ঞা: সাধারণভাবে বলা যায় কোনাে দেশ যদি অন্য দেশের ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে নিজের অধীনস্থ করে নেয় তাহলে সেই অঞ্চলটির নাম হয় উপনিবেশ। ‘Encyclopaedia of Social Sciences’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে উপনিবেশবাদ হল অন্য দেশের ভৌগােলিক অঞ্চলের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ।
উপনিবেশবাদ বলতে কী বোঝো
উপনিবেশবাদ কথাটার ইংরাজি প্রতিশব্দ হল Colonialism যা এসেছে ইংরেজি শব্দ Colony থেকে যার অর্থ বসতি বা বসতি স্থাপন। এখন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে উপনিবেশবাদের সঙ্গে ইংরেজ বা ব্রিটিশ শাসন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ।
উপনিবেশবাদ (Colonialism) বলতে একটি দেশ কর্তৃক অন্য একটি দেশের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে বোঝায়, সাধারণত উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে উদ্দেশ্য থাকে অর্থনৈতিক আধিপত্য।
অর্থাৎ উপনিবেশবাদ হল একটি দুর্বল ভূখণ্ডের উপর একটি প্রভাবশালী দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ।
উপনিবেশবাদ হল অন্য দেশের উপর সম্পূর্ণ বা আংশিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অর্জনের নীতি বা অনুশীলন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশগুলোর লক্ষ্য হল উপনিবেশিত দেশগুলোর মানব ও অর্থনৈতিক সম্পদ শোষণ করে লাভবান হওয়া। এই প্রক্রিয়ায়, উপনিবেশকারীরা-কখনও কখনও জোরপূর্বক-আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর তাদের ধর্ম, ভাষা, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অনুশীলন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
যদিও ঔপনিবেশিকতাকে সাম্রাজ্যবাদের সাথে সাদৃশ্যের কারণে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়, তথাপি কিছু দেশ উপনিবেশের ফলে উপকৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পিছনে ১৮২৬ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ উপনিবেশ ঐতিহ্যের মূল্যবান দিক”কে কৃতিত্ব দেয়।
অনেক ক্ষেত্রে, ঔপনিবেশিক অনুন্নত বা উদীয়মান দেশগুলোকে ইউরোপীয় বাণিজ্য বাজারে অ্যাক্সেস দেয়। শিল্প বিপ্লবের সময় প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য প্রধান ইউরোপীয় দেশগুলো উপনিবেশিত দেশগুলো থেকে প্রযোজনীয় উপকরণ ক্রয় করেছিল।
বিশেষ করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা দ্বারা প্রভাবিত ইউরোপীয়, আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশগুলোর জন্য সুবিধা ছিল। লাভজনক বাণিজ্য চুক্তির পাশাপাশি, ইংরেজী প্রতিষ্ঠান, যেমন সাধারণ আইন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার, এবং ব্যাঙ্কিং এবং ঋণদানের অনুশীলন উপনিবেশ দেশগুলোর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য একটি ইতিবাচক ভিত্তি প্রদান করে যা তাদের ভবিষ্যতের স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করেছিল।
ঔপনিবেশিকতা নেতিবাচক দিকও ছিল ভয়ংকর। যেমন, আদিবাসীদের ওপর কঠোর আইন ও কর আরোপ করা। জন্মভূমি এবং সংস্কৃতি বাজেয়াপ্ত এবং ধ্বংস করা। ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদের সম্মিলিত প্রভাবের কারণে, অনেক আদিবাসীকে ক্রীতদাস করা হয়েছিল, খুন করা হয়েছিল এবং অনেকে রোগ ও অনাহারে মারা গিয়েছিল। সাধারণ মানুষকে তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।
১২০০খ্রীষ্টাব্দ তৎপরবর্তী সময় ম্যাগেলন,কলম্বাস,ভাস্কো-ডা-গামা সহ বহু বিদেশী নাবিক তথা বণিক বিশ্ব কে নতুন করে আবিস্কারের তাগিদেই হোক কিংবা বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগেই হোক তারা কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন অজানা রাষ্ট্র আবিস্কার করেছেন ।
ধীরে ধীরে সেই আবিষ্কারই তাদের নিজেদের দেশের সাথে ও নতুন রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপন, সম্পর্ক বৃদ্ধি,যোগাযোগ, যাতাযাত বৃদ্ধির মাধ্যমে সেই নতুন আবিস্কৃত রাষ্ট্রটি তাদের Second Home হয়ে গেছে, এটাই হল উপনিবেশবাদ বা Colonialism ।
যেমন তৎকালীন গোয়া ছিল পর্তুগীজদের কলোনী এখন ও বহু পর্তুগীজ পরিবার গোয়ার স্থায়ী বাসিন্দা, হুগলী জেলার চন্দননগরও ঠিক তেমনই ফরাসীদের উপনিবেশ,আমেরিকা হয়ে উঠেছিল এর শ্রেণী ইউরোপীয়দের উপনিবেশ।
অর্থাৎ বাণিজ্যিক স্বার্থে যখন কোনো বিদেশী রাষ্ট্র অপর কোনো রাষ্ট্র বা ভূখন্ডে যাতায়াত এবং ক্রমে সেখানে বসতি স্থাপন করার মাধ্যমে একটি আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে তাকেই উপনিবেশবাদ বলে।
উপনিবেশবাদের ইতিহাস
ঔপনিবেশিকতার অনুশীলন প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ অব্দে শুরু হয়েছিল যখন প্রাচীন গ্রীস, রোম, মিশর ফেনিসিয়া সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে শুরু করে। তারা সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার জন্য উচ্চতর সামরিক শক্তি ব্যবহার করেছিল।
আধুনিক ঔপনিবেশিকতার প্রথম পর্যায় ১৫ শতকে শুরু হয়েছিল। ইউরোপের বাইরে নতুন বাণিজ্য পথ এবং সভ্যতার সন্ধানে, পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা ১৪১৯ সালে উত্তর আফ্রিকার সেউটা অঞ্চল জয় করে, একটি সাম্রাজ্য স্থাপন করে যা ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আধুনিক ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ঔপনিবেশিক শাসন হিসাবে বিবেচিত।
১৪৯২ সালে, স্প্যানিশ অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস চীন এবং ভারতের পশ্চিম সমুদ্র পথের সন্ধানে যাত্রা করতে বের হন। কিন্তু, তিনি বাহামাস দ্বীপে অবতরণ করেন এবং সেখানে স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের সূচনা করে। ১৭ শতকে, ফরাসি এবং ডাচ বিদেশী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাথে উপনিবেশবাদ আরো বিকাশ লাভ করে।
উপনিবেশবাদ অবসানের কারণসমূহ
[১] জাতীয় মুক্তি আন্দোলন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিরােধী এই মুক্তিসংগ্রাম চরমে পৌছােয়। এই উপনিবেশ বিরােধী আন্দোলন ঔপনিবেশিক শক্তিকে উদবিগ্ন করে তােলে। ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ, স্পেনীয় শক্তিগুলি উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা প্রদানে বাধ্য হয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সুফল হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে।
[২] জাতীয়তাবাদী চেতনা: ঔপনিবেশিকতাবাদ অবসানের একটি মূল কারণ হল জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ। জাতীয় মুক্তির বাসনা উপনিবেশবাদ বিরােধী মানসিকতাকে তীব্র করে তােলে। ফলে অতীত ঐতিহ্যের জাগরণ শুরু হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন ও শােষণ জাতীয় চেতনার উন্মেষে সাহায্য করে। জাতীয় চেতনার এই জাগরণের ফলেই এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শক্তি হার মানে।
[৩] জাতীয়তাবাদী চেতনা: ঔপনিবেশিকতাবাদ অবসানের একটি মূল কারণ হল জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ। জাতীয় মুক্তির বাসনা উপনিবেশবাদ বিরােধী মানসিকতাকে তীব্র করে তােলে। ফলে অতীত ঐতিহ্যের জাগরণ শুরু হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন ও শােষণ জাতীয় চেতনার উন্মেষে সাহায্য করে। জাতীয় চেতনার এই জাগরণের ফলেই এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শক্তি হার মানে।
[৪] বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব: ইউরােপের বুকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মিত্রশক্তি জোটের রাখা প্রতিশ্রুতির অন্যতম শর্ত হিসেবে বলা হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর উপনিবেশবাসীরা স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করবে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার পর সেই প্রতিশ্রুতি পালিত না হওয়ায় উপনিবেশবাসীরা জাতীয় আন্দোলন গড়ে তােলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যােগদান করে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে, যার দরুন উপনিবেশ বিরােধী আন্দোলনগুলি দমন বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তারা হারায়।
[৫] মার্কিন ও সােভিয়েত ভূমিকা: সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই, মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে ওঠার লক্ষ্যে উপনিবেশগুলিকে স্বাধীন করে নয়া উপনিবেশবাদের মাধ্যমে পরােক্ষভাবে নিজ নিজ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত তিনটি কারণে ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসান চায়। এই কারণগুলি হল- [i] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নি ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং স্পেনের মতাে পশ্চিমি শক্তিগুলি পুনরায় উপনিবেশগুলির সাহায্য নিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠুক। [ii] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ঘােষণা করা হয় যে, মিত্রশক্তিগুলি নিজ নিজ উপনিবেশগুলির প্রতি যুদ্ধের আগে ও পরে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি রেখেছিল সেগুলি ঠিকমতাে পালন করুক। [iii] ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির অপসারণের পর বিশ্বরাজনীতির শূন্যতা পূরণে সােভিয়েতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ইচ্ছুক ছিল।
[৬] রাষ্ট্রসংঘের গঠন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রসংঘ বা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গড়ে উঠলে উপনিবেশবাদের বিলুপ্তির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। রাষ্ট্রসংঘের গৃহীত কর্মসূচিতে উপনিবেশগুলির বিলুপ্তির প্রক্রিয়াকে দ্রুত কার্যকর করার ওপর জোর দেওয়া হয়। রাষ্ট্রসংঘের মহাসনদের একাধিক অনুচ্ছেদে উপনিবেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়। রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাবে বলা হয় প্রতিটি জাতি এবং রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও অধিকার লাভ করবে। উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা লাভের লড়াইয়ে রাষ্ট্রসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু দেশ এগিয়ে আসে। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি নিজ নিজ উপনিবেশ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
[৭] নির্জোট আন্দোলন: নির্জোট আন্দোলন এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা থেকে উপনিবেশবাদকে মুছে ফেলতে বিশেষ সাহায্য করে। নির্জোট সম্মেলনগুলিতে উপনিবেশবাদের বিরােধিতা করা হয়। নির্জোট দেশগুলির নেতৃবর্গ উপনিবেশবাসীদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়।
নয়া উপনিবেশবাদ কি
নব্য উপনিবেশবাদ (Neocolonialism) হলো পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদকে ব্যবহার করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারের কৌশল। অর্থাৎ নয়া উপনিবেশবাদ হল পরোক্ষ উপায়ে উন্নত দেশ বা প্রাক্তন ঔপনিবেশ স্থাপনকারী দেশগুলো দ্বারা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ।
পূর্ববর্তী ঔপনিবেশিক পদ্ধতির মতো, এই ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ সামরিক নিয়ন্ত্রণ কিংবা অপ্রত্যক্ষ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ এটি এমন একটি অনুশীলন যেখানে আধিপত্য বিদ্যমান কিন্তু সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই।
১৯৫৬ সালে ফরাসি দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্র (Neocolonialism) পরিভাষাটি উদ্ভাবন করলেও কোয়ামে এনক্রুমাহ এটি প্রথম ব্যবহার করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, উন্নত দেশ এবং উপনিবেশ শক্তির উপর প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর অব্যাহত নির্ভরতা বোঝাতেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৮৭০-এর দশকের শেষের দিকে, সুয়েজ খাল এবং দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর মধ্যে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা “নতুন সাম্রাজ্যবাদ” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
নয়া উপনিবেশবাদ বলতে কী বোঝো
নয়া উপনিবেশবাদ’- এই কথাটি সর্ব প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি ইতিহাসবিদগণ এবং মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকগণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রায় ছয়ের দশক নাগাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নয়া উপনিবেশবাদ কথাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ৮ এর দশক নাগাদ পুঁজিবাদী দেশগুলির সরকার এবং বহু জাতের সংস্থা (Multinational Corporation) এর আধিপত্যের স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে নয়া উপনিবেশবাদ এক বহুল আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আফ্রো-এশীয় উপনিবেশগুলো একে একে স্বাধীনতা অর্জন করতে থাকে। ফলে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো উপনিবেশ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারা পরোক্ষভাবে তাদের অনুশাসন কায়েম রাখার ফন্দি আঁটতে থাকে।
উপনিবেশগুলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল। কেননা এসব দেশগুলোর মূলধন ও প্রযুক্তির অভাব লক্ষ্যণীয়। আর সে জন্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বহুজাতিক সংস্থার নানা শর্তের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
নয়া উপনিবেশবাদকে ব্যাপকভাবে পুঁজিবাদের বিকাশ হিসাবেও দেখা হয়ে থাকে যা পুঁজিবাদী শক্তি (দেশ এবং সংস্থা) সরাসরি শাসনের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে জাতিগুলোর উপর কর্তৃত্ব করতে সক্ষম। বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং অন্যন্য বহুজাতিক কর্পোরেশন নব্য উপনিবেশিকরনে কাজ করে বলে অনেকে মনে করেন।
উদাহরণস্বরূপ, একটি দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশের কিছু অর্থের প্রয়োজন যা একটি ধনী দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রদান করে। ফলস্বরুপ, ঋণের নামে ধনী দেশটি তার অর্থনীতি, রাজনীতি, বাণিজ্য নীতি এবং সাংস্কৃতিক অংশে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
এটি দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়নের পরিবর্তে শোষণের জন্যও দায়বদ্ধ ছিল। নব্য উপনিবেশকরণ উন্নয়নশীল দেশে ঋণের নামে আরও অনুন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে কারণ সময়ের সাথে সাথে ঋণের সুদের হার বেড়ে যায়।
নয়া উপনিবেশবাদ বৈশিষ্ট্য
নয়া উপনিবেশ বাদ আসলে উপনিবেশবাদের নতুন রূপ। তাই অনেক নয়া উপনিবেশবাদ কে ‘নতুন পাত্রে পুরনো পানীয়’ (Old wine in a bottle) নামে অভিহিত করেন। নয়া উপনিবেশবাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো-
১. উপনিবেশহীন
নয়া উপনিবেশবাদে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনে কোন উপনিবেশ থাকে না। তাই অনেকে নয়া উপনিবেশবাদ কে উপনিবেশ হীন সম্রাজ্যবাদ আখ্যা দিয়ে থাকেন। যদি অতীত উপনিবেশ গুলি অর্থনীতি সহ নানা ক্ষেত্র গুলির ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বাইরে থেকে তা নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখে কিন্তু অতীতের উপনিবেশ গুলি আপাতভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি থাকে।
২. বাজার অর্থনীতি
নয়া উপনিবেশবাদ একটি মূল বৈশিষ্ট্য হল বাজারের অর্থনীতি। বাজারে অর্থনীতিকে হাতিয়ার করে পুঁজিবাদ বর্তমান বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা কে নিয়ন্ত্রণে উদ্যত। এই দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের হাত ধরে বাজারে অর্থনীতি প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাজারে অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ হয়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পক্ষে বাজারে অর্থনৈতিক ক্ষতিকর দিকগুলি মোকাবিলা করার সামর্থ্য নেই। তাই বহু জাতি সংস্থাগুলির মাধ্যমে পুঁজিবাদী তৃতীয় বিশ্বের ওপর একাধিপত্য স্থাপন করে।
৩. আনুষ্ঠানিকতাহীন সাম্রাজ্যবাদ
অনেক ধারণাই নয়া উপনিবেশবাদ আনুষ্ঠানিক অধ্যাহীন সম্রাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ এই ব্যবস্থায় সরাসরি সাম্রাজ্য স্থাপন না করে বাইরে থেকে সুখ কৌশলের তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানে সু কৌশল বলতে বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক অনুদান, আধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য দানকে বোঝানো হয়েছে। আসলে সময় এখনো সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপনিবেশিক শক্তি গুলি নিজে নিয়ন্ত্রণ কৌশল বদলে চলেছে।।
৪. অর্থনীতি অধীনতা
নয়া উপনিবেশবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো অর্থনৈতিক অভিনেতা। ধনী বিশ্বের বহুজাতিক সংস্থা গুলি প্রতিদিনের উপনিবেশ গুলি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এগিয়ে আসবে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি মূলত তিনটি উপায়ে বহির বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, যথা – (১) মূলধনের লগ্নি। (২) প্রযুক্তিগত কলা কৌশল সরবরাহ। (৩) পরিচালনা দক্ষতার ধারণা দান। কোন দেশের শিল্প ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য এই তিনটি উপাদান উপরিহার্য। তাই অনুন্নত দেশ বলে নিজেদের শিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে বহুজাতিক সংস্থা গুলির এই দুর্বল অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি শিল্পোন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
৫. সমরগত নিয়ন্ত্রণ
নয়া উপনিবেশবাদের মাধ্যমে সমর্গত ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণগত উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা চালানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো তথাকথিত শক্তিশালী দেশ গুলি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দুর্বল দেশগুলির ওপর এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা চালায়। বিশ্বের শক্তিধর এই দেশগুলি দুর্বল দেশগুলোকে কখনো ও ভয় দেখিয়ে আবার কখনো লোভ দেখিয়ে নিজে নিজে সামরিক জোটের অন্তর্ভুক্ত করা বা তাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চালায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নাট্য, সিয়াটো, সেন্টো বা বাগদাদা চুক্তি, অ্যানজাস চুক্তি প্রভৃতি গঠনের মাধ্যমে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি দুর্বল দেশগুলির ওপরে সামরিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশগুলো নিজেদের সমর কৌশলে অঙ্গ রূপে না আমি অনুন্নত দেশগুলিতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। এছাড়াও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে অনেক সময় দুর্বল দেশগুলিকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য দিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে সে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেই সরকারকে শেষ পর্যন্ত পুতুল সরকারের পরিণত করে।
৬. আর্থিক শোষণ
নয়া উপনিবেশবাদ পূর্বতন উপনিবেশবাদের অস্তিত্ব না থাকলেও আর্থিক শোষণ গত ভূমিকা বজায় থাকে। নয়া উপনিবেশবাদের তথাকথিত দুর্বল দেশগুলো অর্থ ও সম্পদ আত্মসাৎ করার সুতীব্র বাসনা লক্ষ্য করা যায়। তবে সরাসরি এই অর্থ ও সম্পদ শোষণ করা সম্ভব হয় না। অনন্যা তো দেশগুলিকে আর্থিক ঋণদান করে বিপুল সুদের বোঝা চাপিয়ে এই শোষণ করা হয়। এছাড়াও অনুন্নত দেশগুলোতে উন্নত দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ হল নয়া উপনিবেশবাদী শোষণের আরেকটি মাধ্যম তাই বলা যায় না নয়া উপনিবেশ বাদে রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা অপেক্ষা আর্থিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা বা সুযোগ-সুবিধা লাভ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে মাইকেল ব্যারাট ব্রাউন লিখেছেন – “Imperialist control , now depends more on economic domination than on political rule “.
৭. রাজনৈতিক ভিত্ত
ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন স্থানে নিজে নিজে উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তবে ঊনবিশ ও বিষ শতকের ইউরোপের শিল্প উন্নত দেশগুলি যে নয়া সাম্রাজ্যবাদী বা নয়া উপনিবেশিকতাবাদী নীতি গ্রহণ করে তা পূর্ববর্তী যুগে উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবতী নীতির চেয়ে অনেক তীব্র ও সক্রিয় ছিল। ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তি গুলি তৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশিক স্থাপনে হয়েছিল।
তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, তাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশিক ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। উপনিবেশী রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলি প্রকৃতপক্ষে উপনিবেশ নিজের সামগ্রিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতো। রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে উপনিবেশের অর্থনৈতিক, সামরিক সামাজিক, ধর্মীয় প্রবিতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহজেই নিজেদের একাধিক পত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হতো।
উপনিবেশবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ হল আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের দুটি উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক ধারণা। সাম্রাজ্যবাদের সাফল্য শেষপর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তাই অনেক সময় এই দুটি বিষয়কে একই অর্থে ব্যবহার করা হলেও আসলে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দুইই লক্ষ করা যায়ㅡ
সাদৃশ্য: উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য সাদৃশ্যগুলি হলㅡ
- উভয়েরই লক্ষ্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের দ্বারা দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করা।
- কোনাে শক্তিশালী দেশের সাম্রাজ্যবাদী নীতি বাস্তবায়নের অন্যতম একটি উপায় হল উপনিবেশবাদ।
- উপনিবেশবাদ একপ্রকার দুর্বল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন।
- উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ উভয়েরই লক্ষ্য হল অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালানাে।
বৈসাদৃশ্য: উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে অনেকগুলি বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়ㅡ
- অর্থগত: উপনিবেশবাদ বলতে বাঝায় দেশের সীমান্তের বাইরে কোনাে রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন অথবা রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে একটি ভূখণ্ড উক্ত রাষ্ট্রের কাছে নির্দিষ্টভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদ বলতে বােঝায় যখন কোনাে দেশ তার সীমানার বাইরে অন্য দেশের ওপর জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে এবং সেই দেশটিকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে।
- প্রকৃতিগত: ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে বহু মানুষ এসে বসবাস করে এবং এদের আনুগত্য থাকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রটির প্রতি। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের জনগণ নতুন দখলিকৃত রাষ্ট্রে বসবাস নাও করতে পারে। এখানে নতুন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেওয়া হয় এবং সেখানে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের আধিপত্য স্থাপিত হয়।
- কৌশলগত: উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক জনগণ নতুন এলাকায় উপনিবেশ স্থাপন করে সেই উপনিবেশবাসীরাই সেখানে নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে সেখানকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কায়েম করে। যেমন আমেরিকায় ইংল্যান্ডের উপনিবেশ। অপরদিকে, সাম্রাজ্যবাদের কৌশল হল সামরিক অভিযানের মাধ্যমে অন্য কোনাে স্থান নিজ দখলে এনে সেখানে প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
- প্রাচীনত্নের দিক থেকে: মােটামুটিভাবে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের পর থেকে উপনিবেশবাদের প্রসার শুরু। এই সময় উন্নত নৌশক্তিধর রাষ্ট্রগুলি বাণিজ্যের প্রসার ঘটানাের উদ্দেশ্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় মন দেয়। তাই উপনিবেশবাদ হল অপেক্ষাকৃত নতুন ভাবধারা। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা অনেক বেশি প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে আসছে।
উপসংহার: আসলে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরস্পরের পরিপূরক ধারণা। তাই দুটি ধারণা সংযুক্ত হয়ে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ধারণাটির প্রচলন ঘটেছে।
আরো অন্যান্য অতি জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন
FAQ | উপনিবেশ
Q1. আলজেরিয়া কাদের উপনিবেশ ছিল
Ans – আলজেরিয়ার উপনিবেশ ছিল ফ্রান্সের।
Q2. কানাডায় কারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল
Ans – কানাডায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল ফ্রান্সের।
Q3. আফ্রিকাতে প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করেছিল
Ans – আফ্রিকাতে ব্রিটিশরা প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন।
প্রায় পনেরো শতকের সময় থেকেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল।
Q4. গোয়ায় কাদের উপনিবেশ ছিল
Ans – গোয়ায় পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল।
আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন।