মৌলিক গণতন্ত্র কি
মৌলিক গণতন্ত্র হল এমন এক ধরণের সীমিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যেখানে সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রদানের পরিবর্তে কিছু সংখ্যক নির্ধারিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জাতীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের করা হয়।
মৌলিক গণতন্ত্র (Basic Democracy) হলো জেনারেল আইয়ুব খানের এক অভিনব শাসন ব্যবস্থা। ১৯৫৮ সালে এক সামরিক অভ্যূত্থান ঘটিয়ে আইয়ুব খান পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করে। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে ২৬ অক্টোবর ক্ষমতা গ্রহণের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মৌলিক গণতন্ত্র নামে এক ধরণের শাসন ব্যবস্থার আদেশ জারি করেন। তাই আইয়ুব খানকে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার প্রবর্তক বলা হয়।
আইয়ুব খান পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে নতুন চার স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করেন। মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা একাধিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য গঠন করা হয়েছিল।
এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে এটি জনগণের ইচ্ছাকে সরকারের কাছাকাছি এবং সরকারী কর্মকর্তাদেরকে জনগণের কাছাকাছি এনে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্পন্ন করবে। আইয়ুব খান বলেন, ”It will be a foundation stone of a new political system in the country.” অর্থাৎ এটি হবে দেশে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর।
মৌলিক গণতন্ত্র কে প্রবর্তন করেন
জেনারেল আইয়ুব খান ‘মৌলিক গনতন্ত্রের’ ধারণা প্রবর্তন করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ২৬ অক্টোবর তাঁর ‘মৌলিক গনতন্ত্র আদেশ’ ঘোষণা করেন। মৌলিক গনতন্ত্র ব্যবস্থায় পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে ৪০,০০০ করে মোট ৮০,০০০ ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য নিয়ে দেশের নির্বাচকমন্ডলী গঠিত হয়। এদের দ্বারা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, জাতীয়, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দ নির্বাচনের বিধান করা হয়।
এই পদ্ধতিতে পরোক্ষ নির্বাচন সৃষ্টি করে নাগরিকদেরকে প্রত্যক্ষ ভোটের অধিকার হরণ করা হয়। মূলত এটিই আইয়ুব খানের মৌলিক গনতন্ত্র নামে পরিচিত।
আরো পড়তে: গণতন্ত্র কাকে বলে, গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভ কি কি, গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কি বুঝ, মৌলিক গণতন্ত্র কি ব্যাখ্যা করো
মৌলিক গণতন্ত্র ১৯৬০-এর দশকে জেনারেল আইয়ুব খানের শাসনামলে প্রবর্তিত একটি স্থানীয় সরকার পদ্ধতি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান একটি নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ ১৯৫৯ জারি করেন। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশ এ সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পোষণ করত এবং তারা একে জেনারেল আইয়ুব খান এবং তাঁর সহযোগী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার একটি সুনিপূণ কৌশল হিসেবেই গণ্য করত।
প্রারম্ভিক পর্যায়ে মৌলিক গণতন্ত্র ছিল একটি পাঁচ স্তরবিশিষ্ট ব্যবস্থা। নিম্ন থেকে শুরু করে এ স্তরগুলো ছিল
- (১) ইউনিয়ন পরিষদ (পল্লী এলাকায়) এবং শহর ও ইউনিয়ন কমিটি (পৌর এলাকায়),
- (২) থানা পরিষদ (পূর্ব পাকিস্তানে), তহশিল পরিষদ (পশ্চিম পাকিস্তানে),
- (৩) জেলা পরিষদ,
- (৪) বিভাগীয় পরিষদ এবং
- (৫) প্রাদেশিক উন্নয়ন উপদেষ্টা পরিষদ।
একজন চেয়ারম্যান এবং প্রায়শ ১৫ জন সদস্য নিয়ে একেকটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হতো। এতে নির্বাচিত এবং মনোনীত উভয় ধরনের সদস্যই থাকতেন। পরিষদের সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিলেন নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন মনোনীত বেসরকারি সদস্য, যারা সরকার কর্তৃক নিয়োজিত হতেন। তবে, ১৯৬২ সালের এক সংশোধনী দ্বারা মনোনয়ন প্রথা বিলোপ করা হয়। ফলে পরিষদের সদস্যবৃন্দ প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে স্ব স্ব ইউনিয়নের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরোক্ষভাবে সদস্যদের দ্বারা তাদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হতেন। এক দিক দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ ছিল পূর্বেকার ইউনিয়ন বোর্ডেরই অনুরূপ, তবে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বলা হতো মৌলিক গণতন্ত্রী। সারা দেশে সর্বমোট পরিষদের সংখ্যা ছিল ৭৩০০।
সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের প্রতিনিধি নিয়ে দ্বিতীয় স্তরের থানা পরিষদ গঠিত হতো। এসকল প্রতিনিধি নিজেরা ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদ এবং শহর কমিটির চেয়ারম্যান। সরকারি সদস্যবৃন্দ দেশ গঠনমূলক কাজে থানার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং এদের সংখ্যা নির্ধারণ করতেন সংশ্লিষ্ট জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট। তবে, সরকারি সদস্যদের সর্বমোট সংখ্যা কোনো ক্রমেই বেসরকারি সদস্যদের সংখ্যার চেয়ে বেশি হতে পারত না। থানা পরিষদের প্রধান থাকতেন মহকুমা অফিসার (এস ডি ও), যিনি পদাধিকারবলে থানা পরিরষদের চেয়ারম্যান হতেন। মহকুমা অফিসারের অনুপস্থিতিতে সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) পদাধিকারবলে থানা পরিষদের সদস্য হিসেবে পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করতেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে থানাকে তহসিল বলে অভিহিত করা হতো এবং তহসিলের সভায় সভাপতিত্ব করতেন তহশিলদার। তখন পাকিস্তানে মোট ৬৫৫টি থানা ও তহশিল ছিল।
তৃতীয় স্তরে ছিল জেলা পরিষদ। একজন চেয়ারম্যান এবং সরকারি ও বেসরকারি সদস্যদের নিয়ে এ পরিষদ গঠিত হতো। সদস্যদের সংখ্যা ৪০-এর বেশি হতো না। সকল থানা পরিষদের চেয়ারম্যানই সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের সদস্য থাকতেন এবং উন্নয়ন বিভাগের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অন্যান্য সরকারি সদস্য মনোনীত হতেন এবং সমান সংখ্যক সদস্য মনোনীত হতেন বেসরকারি সদস্যদের মধ্য থেকে। বেসরকারি সদস্যদের অন্তত অর্ধাংশ মনোনীত হতেন ইউনিয়ন পরিষদ ও শহর কমিটির চেয়ারম্যানদের মধ্য থেকে। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট পদাধিকারবলে এ পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন এবং পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে চেয়ারম্যান কর্তৃক তাঁর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতেন ভাইস-চেয়ারম্যান। পাকিস্তানে ৭৪টি জেলা পরিষদ ছিল। মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ছিল জেলা পরিষদ। এটি ছিল জেলা বোর্ডের উত্তরসূরী প্রতিষ্ঠান। সদস্যসংখ্যার দিক দিয়ে এ পরিষদ ১৮৮৫ সালের অবস্থান থেকে অনেকখানি সরে এসেছে, কেননা তখন শতকরা ২৫ ভাগ সদস্য মনোনীত হতো।
চতুর্থ ও শীর্ষ স্তর ছিল বিভাগীয় পরিষদ। বিভাগীয় কমিশনার পদাধিকারবলে এ পরিষদের চেয়ারম্যান থাকতেন। এতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের সদস্য ছিলেন। সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য ছিলেন ৪৫ জন। সরকারি সদস্য ছিলেন বিভাগের অন্তর্গত সকল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সরকারি উন্নয়ন বিভাগের প্রতিনিধিবর্গ। সর্বমোট বিভাগীয় পরিষদের সংখ্যা ছিল ১৬।
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় পাকিস্তানের দুই অংশে একটি করে প্রাদেশিক উন্নয়ন উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা ছিল। গঠনবিন্যাসের দিক দিয়ে এটি ছিল বিভাগীয় পরিষদের অনুরূপ। ব্যতিক্রম এই যে, নিয়োজিত সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মধ্য থেকে বেছে নেয়া হতো। এ পরিষদের বলতে গেলে কোন ক্ষমতাই ছিল না। তবে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদ গঠিত হওয়ার পর এ পরিষদ বাতিল হয়ে যায়।
মৌলিক গণতন্ত্র আদেশবলে যে পাঁচটি পরিষদ সৃষ্টি করা হয় তাদের মধ্যে শুধু দু’টি পরিষদ অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বিভাগীয় পরিষদ এবং থানা পরিষদ প্রধানত সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করত। ইউনিয়ন পরিষদ বিভিন্ন ধরনের কার্যে নিয়োজিত থাকত, যেমন ইউনিয়নের কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, সমাজ উন্নয়ন এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি সংক্রান্ত কার্যক্রম। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম পুলিশবাহিনীর দ্বারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করত এবং তদীয় সালিসি কোর্টের মাধ্যমে ছোটখাটো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করত। গ্রামের রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ ও কালভার্ট নির্মাণ, জমিতে জলসেচ ব্যবস্থা, বাঁধ নির্মান প্রভৃতি কাজের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বভারও ন্যস্ত ছিল ইউনিয়ন পরিষদের উপর। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদকে কর ধার্য ও আদায় এবং মূল্য, টোল ও ফি আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, এটি রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পরিষদ এবং দুটি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচনের জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৮০,০০০ সদস্য সমন্বয়ে নির্বাচকমন্ডলী গঠন করে।
থানা পরিষদ, তহশিল পরিষদ মূলত একটি সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানমূলক সংগঠন। থানা পরিষদ তার আওতাধীন সকল ইউনিয়ন পরিষদ ও শহর কমিটির কার্যক্রমের সমন্বয় বিধান করত। থানা পরিষদই চলতি প্রকল্পসমূহ তত্ত্বসাধনসহ ইউনিয়ন পরিষদ এবং শহর কমিটির প্রণীত সকল উন্নয়ন পরিকল্পনার সমন্বয় বিধান করত। থানা/তহশিল পরিষদ জেলা পরিষদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করত এবং ঐ পরিষদের নিকট দায়ী থাকত। জেলা পরিষদ মূলত তিন ধরনের দায়িত্ব পালন করতো : বাধ্যতামুলক দায়িত্ব, ঐচ্ছিক দায়িত্ব এবং সমন্বয়মূলক দায়িত্ব। বাধ্যতামূলক দায়িত্বগুলোর মধ্যে ছিল সরকারি রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট ও ব্রীজ নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয় রক্ষণাবেক্ষণ, বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ, সরকারি ফেরী নিয়ন্ত্রণ এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন। ঐচ্ছিক দায়িত্বগুলোর বিষয় ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক কল্যাণ এবং গণপূর্ত। এছাড়াও জেলা পরিষদের উপর কৃষি, শিল্প, সমাজ উন্নয়ন, জাতীয় পুনর্গঠনের প্রসার এবং সমবায় উন্নয়নের মত বিশাল কর্মকান্ডের দায়িত্বও অর্পিত হয়। জেলার মধ্যে স্থানীয় পরিষদসমূহের সকল কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধনও ছিল জেলা পরিষদের অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়া জেলা পরিষদ জাতি গঠনমূলক বিভাগসমূহের গৃহীত পরিকল্প এবং এগুলোর আরও উৎকর্ষ ও উন্নয়ন সাধনের প্রস্তাব দান এবং বিভাগীয় পরিষদ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট এ প্রস্তাব সম্বলিত সুপারিশ পেশ করবে। চতুর্থ স্তরের সংগঠন বিভাগীয় পরিষদ কার্যত একটি অত্যন্ত কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এটি ছিল ঐ স্তরের একটি উপদেষ্টা পরিষদ বিশেষ।
মৌলিক গণতন্ত্র স্থানীয় সরকারের ভিত্তি হিসেবে বলবৎ থাকা ছাড়াও জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারকে বৈধতা দানের জন্য রাজনৈতিক ও নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করত। ১৯৬০ সালের ১৪ ফ্রেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য যে রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হয়, তাতে মৌলিক গণতন্ত্রীরা আইয়ুব খানের সপক্ষে রায় দেয়। গ্রাম ও শহরাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক জনগণ মৌলিক গণতন্ত্রী কর্তৃক একচেটিয়া নির্বাচনী অধিকার প্রয়োগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে, যার ফলে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যত্থান ঘটে। মৌলিক গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুধু যে আইয়ুব সরকারকে বৈধতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, বরং ১৯৬৯ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের পতনের পর এর নিজস্ব বৈধতাও হারিয়ে ফেলে।
মৌলিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি, মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ
১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি এক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সারা দেশে ইউনিয়ন স্তরে ৮০ হাজার মৌলিক ‘গণতন্ত্রী বা Basic Democrats নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর আস্থাসূচক ভোটে (“হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট) জেনারেল আইয়ুব খান পাঁচ বছরের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের সমর্থনের জোরেই আইয়ুব খান তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে সুসংহত করতে সমর্থ হন।
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার কিছু কিছু ভাল দিক থাকলেও অচিরে তা স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। অধ্যাপক ড. মোঃ মকসুদুর রহমান-এর মতে, “স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার সাধারণত অরাজনৈতিক।
জাতীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে এ ধরনের সরকারগুলো মুক্ত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু মৌলিক গণতন্ত্রের আওতায় গঠিত ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যগণ দেশের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তাঁরা নির্বাচিত হতেন না, হতেন প্রথমত নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে এবং নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবার পর দায়িত্ব ছিল দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় এবং প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের নির্বাচন করা।
এ দায়িত্ব পালনের পর তারা কাউন্সিলের সদস্যে পরিণত হতেন। ইউনিয়ন কাউন্সিল একটি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হলেও এর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রবল। কাউন্সিলের যাবতীয় বিষয় তদারক করার ক্ষমতা সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর প্রদান করা হত। সরকারি আমলাদের ক্ষমতা এত ব্যাপক ছিল যে, তারা প্রয়োজনমত কাউন্সিলই বাতিল করতে পারতেন।
মৌলিক গণতন্ত্র যে মূল অথচ ভুল ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় তা ছিল এই যে, জনগণ অজ্ঞ এবং পূর্ণ গণতন্ত্রের অযোগ্য। এখানে মধ্যবর্তী এক স্বার্থবাদী দল সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র কায়েমের অপচেষ্টা করা হয়। আইয়ুব সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন অটুট রাখার জন্য এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের সৃষ্টি করা হয়েছিল।
মৌলিক গণতন্ত্র না ছিল মৌলিক না ছিল গণতন্ত্র অর্থাৎ এর মধ্যে গণতান্ত্রিক কোন ধারাই বিকশিত হয়নি। মৌলিক গণতন্ত্র ছিল একটি মৌলিক প্রতারণা। আইয়ুব শাসনামলের শেষ দিকে মৌলিক গণতন্ত্রের বিশেষ করে এর দুর্নীতি ও অরাজকতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান তার ক্ষমতাকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যেই মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। এ অধ্যাদেশের মাধ্যমেই জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করা হয়।
মৌলিক গণতন্ত্রের স্তর কয়টি
মৌলিক গণতন্ত্র ছিল একটি চার স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন কাঠামো যার মধ্যে রয়েছে: ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, এবং বিভাগীয় কাউন্সিল।
১. ইউনিয়ন কাউন্সিল
ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন স্তর। ৫ থেকে ৮ টি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠিত হয় যার জনসংখ্যার সীমা ছিল প্রায় ১০,০০-১৫,০০০ জন। পৌর এলাকায় এটির নাম ছিল ইউনিয়ন কমিটি এবং ছোট শহরে এর নাম ছিল টাউন কমিটি। সর্বমোট ১৫ জন সদস্য নিয়ে একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠিত। এর মধ্যে ১০ জন জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হত, বাকি ৫ জন মনোনীত। কিন্তু ১৯৬২ সালে এই মনোনয়ন পদ্ধতি বাতিল করা হয়।
ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরা নিজের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতেন। পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মোট ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীর (Basic Democrats) সংখ্যা নির্ধারিত হয় যারা পরবর্তীতে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচনে অথবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেক্টরাল কলেজ হিসেবে কাজ করে।
কার্যাবলী: এই কাউন্সিলগুলোর সদস্যদেরকে বিচার বিভাগীয়, অর্থনৈতিক, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন উন্নয়নের মতো বিভিন্ন কার্যভার দেওয়া হয়। সবশেষে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য এই ইউনিয়ন পরিষদকে ইলেক্টোরাল কলেজে রূপান্তর করা হয়।
২. থানা কাউন্সিল
মৌলিক গণতন্ত্রের স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তর ছিল থানা কাউন্সিল। এই পরিষদে কোনো নির্বাচন হত না। এটি কিছু অফিসিয়াল এবং কিছু বেসরকারী সদস্য নিয়ে গঠিত। বেসরকারী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন থানার অন্তর্গত সকল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং অফিসিয়াল সদস্যদের মধ্যে ছিলেন থানার সকল সরকারি কর্মকর্তা। অফিসিয়াল সদস্য সংখ্যা ছিল বেসরকারী সদস্যদের সমান। এই থানা কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন মহকুমা প্রশাসক।
কার্যাবলী: এটি থানার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের মধ্যে এবং জেলা একটি সমন্বয়কারী সংস্থা হিসাবে কাজ করত।
৩. জেলা কাউন্সিল
থানা কাউন্সিলের ওপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ছিল জেলা কাউন্সিল। এর সদস্য সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৪০ জন যার অর্ধেক সদস্য ছিল সরকারী কর্মকর্তা এবং বাকি অর্ধেক নির্বাচিত প্রতিনিধি। এসব নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের থেকে নির্বাচিত হত। অফিসিয়াল বা সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল এস ডি, নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা কৃষি কর্মকর্তা, বন বিভাগীয় কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, বিদ্যুত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা আনসার এডজুটেন্ট, এবং সহকারী রেজিস্টার ইত্যাদি।
কার্যাবলী: জেলা কাউন্সিল আর্থিক এবং নির্বাহী ক্ষমতা সম্পাদন করত। এছাড়া জেলার অন্তর্গত বিভিন্ন উন্নয়ন ফাংশন এবং কর আরোপ করতে নিয়োজিত ছিল। জেলা প্রশাসকের কার্যাবলী ও ক্ষমতা ২ ভাগে বিভক্ত ছিল।
- বাধ্যতামূলক: বাধ্যতামূলক ফাংশন সমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল বিদ্যালয়, গ্রন্থাগার হাসপাতাল, পাবলিক রাস্তা, খেলার মাঠ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণাবেক্ষণ।
- ঐচ্ছিক: ঐচ্ছিক ফাংশনগুলোর মধ্যে রয়েছে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা, মানুষের সংস্কৃতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত।
৪. বিভাগীয় কাউন্সিল
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর ছিল বিভাগীয় কাউন্সিল। সর্বমোট ৪৫ জন সদস্য নিয়ে বিভাগীয় কাউন্সিল গঠিত হয় যাদের অর্ধেক ছিল সরকারী কর্মকর্তা এবং বাকি অর্ধেক ছিল জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিবর্গ। বেসরকারী সদস্যদের প্রায় অর্ধেক ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে নির্বাচিত হতেন।
বিভাগীয় কমিশনার তার পদাধিকার বলে বিভাগীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিভাগীয় কাউন্সিলের কার্যালীর মধ্যে ছিল বিভিন্ন জেলা কাউন্সিলের সাথে সমন্বয় করা।
আরো অন্যান্য সরকারি স্কিম সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন
FAQ | মৌলিক গণতন্ত্র
Q1. মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ কে জারি করেন, ১৯৬২ সালে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেন কে
Ans – মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন জেনারেল আইয়ুব খান।
Q2. মৌলিক গণতন্ত্রে কতজন ভোটাধিকার ছিল
Ans – মৌলিক গণতন্ত্রে ভোটাধিকার সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, কারণ প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হওয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট মাপদণ্ড নেই। তবে, একটি প্রস্তাব থাকে যে, মৌলিক গণতন্ত্রে সকল পুরুষ এবং মহিলা ভোটাধিকারী ছিলেন এবং তাদের ভোট দেওয়া হতো সমানভাবে।
আপনি কি চাকরি খুজঁছেন, নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সংবাদ পেতে ক্লিক করুন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাড়ার জন্য, ক্লিক করুন। হিন্দিতে শিক্ষামূলক ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। এছাড়াও, স্বাস্থ, টেকনোলজি, বিসনেস নিউস, অর্থনীতি ও আরো অন্যান্য খবর জানার জন্য, ক্লিক করুন।